দরিদ্র-অসচ্ছল হয়েও টিসিবির কার্ড পায়নি ৩৯.৫ শতাংশ পরিবার: টিআইবি
রাজনৈতিক প্রভাব, ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ৩৯.৫ শতাংশ অসচ্ছল ও দরিদ্র পরিবারের ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) কার্ড পাওয়ার কথা থাকলেও, তাদেরকে কার্ড দেওয়া হয়নি বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর এক জরিপে উঠে এসেছে।
চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসে টিসিবি কর্তৃক এক কোটি পরিবারকে ফ্যামিলি কার্ডের মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে দুই দফায় তেল, চিনি, ছোলা, ডাল ও পেঁয়াজ বিতরণ করা হয়। যেখানে করোনার সময় ২৫০০ টাকা করে নগদ সহায়তা দেওয়া ৩৮.৫ লাখ পরিবারের অন্তর্ভুক্তি থাকার কথা ছিল। নগদ সহায়তা পাওয়া এসব পরিবারের উপর গবেষণা করে বৃহস্পতিবার 'টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড কার্যক্রমে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ' শীর্ষক এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে টিআইবি।
ফ্যামিলি কার্ডের জন্য পরবর্তীতে আরও ৬১.৫ লাখ পরিবারকে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তাদেরকে এই জরিপের আওতায় আনা হয়নি।
টিআইবি ৩৫টি জেলা থেকে মোট ১০৪৭ পরিবারের সাক্ষাতকার গ্রহণ করে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৩৯.৫ শতাংশ পরিবার টিসিবির কার্ড পায়নি। যাদের মধ্যে ৮০.৪ শতাংশ বলেছেন তারা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বাদ পড়েছেন, স্বেচ্ছায় কার্ড নেননি ৫.৫ শতাংশ এবং বাদ পড়ার কোন কারণ জানে না ১৪.১ শতাংশ।
কার্ড না পাওয়া পরিবারগুলো জানায়, তদবির-সুপারিশ না থাকা, যোগ্য নয় এমন ব্যক্তিদের কার্ড দেওয়া, রাজনৈতিক বিবেচনায় বাদ দেওয়া, ছবি-আইডি কার্ড নিয়েও কার্ড না দেওয়া, কার্ডের স্বল্পতার অজুহাত, একই পরিবারে একাধিক কার্ড দেওয়া, ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ না দেওয়া ইত্যাদি কারণে তাদেরকে বাদ পড়তে হয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, স্বল্প আয়ের ২৫-৩০ শতাংশ জনগণ যে সুবিধা পাওয়ার কথা মোটাদাগে সেটা অর্জন হয়েছে। তবে রাজনৈতিক চাপ, ব্যবস্থাপনার সংকটে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে যাদের পাওয়ার কথা তাদের মধ্যে ৩৯.৫ শতাংশ এই সুবিধাটা পায়নি, বঞ্চিত হয়েছে। এর মধ্যে তুলনামূলক বেশি বঞ্চিত হয়েছে নারীরা।
তিনি বলেন, 'রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের কারণে যাদের পাওয়ার কথা নয়, তারাও পেয়েছে। অনেকে প্রতারণার শিকার হয়েছে। একই পরিবার একাধিক কার্ড পেয়েছে এবং অভিযোগ নিরসনের কোন ব্যবস্থা ছিল না।'
অংশগ্রহণকারী উত্তরদাতাদের ৫১.৩ শতাংশ মনে করেন তালিকাভুক্তিতে যোগ্য হতদরিদ্র ব্যক্তিদেরকে বাদ দিয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সচ্ছল ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও তাদের আত্মীয়-স্বজনদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
যার মধ্যে ৭৬.১ শতাংশ অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তি, ৬৫ শতাংশ জনপ্রতিনিধিদের আত্মীয়-স্বজন, ৪৪.৫ শতাংশ স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, ৪৪.৫ শতাংশ রাজনৈতিক ব্যক্তি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্য ৭.১ শতাংশ এবং পণ্য বিক্রয়কারী ডিলার ৫.২ শতাংশ।
এদিকে যারা কার্ড পেয়েছে তাদের মধ্যেও অনেকেই দুর্নীতির শিকার হয়েছে। উত্তরদাতাদের ৮ শতাংশ অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। তারা বলছেন, কার্ড প্রাপ্তিতে উপকারভোগীদের ৫০-২০০ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে।
আবার সামর্থ্যের অভাবে কিছু দরিদ্র মানুষ পণ্যও ক্রয় করতে পারেনি। জরিপের উত্তরদাতাদের মধ্যে ৭.৫ শতাংশ পরিবার একবারও পণ্য ক্রয় করতে পারেনি।
রোজার আগে ও মাঝে এক কার্ড দিয়ে দুইবার তিনটি ও চারটি পণ্যের প্যাকেজ ক্রয় করেছে পরিবারগুলো। প্যাকেজের মূল্য ছিল যথাক্রমে ৪৬০ ও ৫৬০ টাকা। এমন অনেক পরিবার পাওয়া গেছে যারা ইচ্ছে করেই কার্ড নেয়নি।
পণ্য নেওয়ার সময়ও মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। টিসিবির ট্রাক বা ডিলারের কাছ থেকে পণ্য কেনার সময় অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হয়েছে ১৩.৭ শতাংশ উপকারভোগী। এর মধ্যে নিম্নমানের পণ্য, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে অতিরিক্ত পণ্য বিক্রয়, ট্রাক না আসায় অপেক্ষা করে ফেরত যাওয়া, সিরিয়াল আসার পূর্বেই সরবরাহকারীর মজুদ শেষ হয়ে যাওয়া, প্যাকেজে উল্লিখিত পরিমাণের চেয়ে কম পণ্য বিক্রয়, তালিকায় নির্ধারিত মূল্যের অতিরিক্ত দামে পণ্য ক্রয় করতে বাধ্য করা। কিছুক্ষেত্রে পণ্য ক্রয়ের সময় ডিলার/বিক্রয়কর্মী নিয়মবহির্ভূতভাবে ৪০-৫০ টাকা বেশি আদায় করেছে।
৩৩ শতাংশ উপকারভোগী প্যাকেটে নিম্নমানের পণ্য পেয়েছে। এর মধ্যে দলাপাকানো ডাল, শক্ত হয়ে যাওয়া চিনি, নিম্নমানের ভোজ্যতেল পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পরবর্তীতে এ ধরনের উদ্যোগ থাকলে দলীয় বিবেচনা, স্থানীয় প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
টিআইবি আরও বলছে, তবে ৩৮.৫ লাখ পরিবার যারা নগদ সহায়তা পেয়েছিল, তাদের মধ্যে শুরুতেই ৮.৫ লাখ পরিবারকে বাদ দেওয়া হয়েছে (এর মধ্যে লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়া পরিবহন শ্রমিক, পেশাজীবী ইত্যাদি)। তবে ফ্যামিলি কার্ড সংশ্লিষ্ট প্রজ্ঞাপনে এ ধরনের কোনো নির্দেশনা লক্ষ্য করা যায়নি। কোন বিবেচনা ও প্রক্রিয়ায় এবং অর্থনৈতিক অবস্থা যাচাইপূর্বক তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে তা জানা যায়নি।