নারীর পোশাক বিষয়ক আদালতের পর্যবেক্ষণ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড়!
চলতি বছরের ১৮ মে নরসিংদী রেলস্টেশনে পোশাকের কারণে গালিগালাজ, মারধরের শিকার হন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া এক তরুণী। ওই তরুণীর পরনে ছিল জিন্স প্যান্ট ও স্লিভলেস টপস।
ওই মারধরের ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এরপর ওই তরুণীকে হেনস্তার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় মার্জিয়া আক্তার ওরফে শিলা নামের এক নারী ও ইসমাইল মিয়া নামের এক যুবককে।
ওই তরুণীকে হেনস্তার অভিযোগে করা মামলায় মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) আসামি শিলার জামিন শুনানিতে হাই কোর্ট পর্যবেক্ষণ দেন।
হেনস্তার শিকার হওয়া ওই তরুণী যে ধরনের পোশাক পরেছিলেন, তা দেশের বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই কি না—এ প্রশ্ন তুলে আদালত প্রশ্ন রেখেছেন, সভ্য দেশে এমন পোশাক পরে রেলস্টেশনে যাওয়া যায় কি না। আদালত বলেছেন, '(ওই তরুণী) প্ল্যাটফর্মে আপত্তিকর অবস্থায় ছিল, সিডিতে দেখা যায়। এটি আপনার অধিকার? পোশাকের অধিকার?'
আদালত আরও বলেন, 'কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ করার অধিকার আছে কি না? পোশাক সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে না? যে সমাজে যাবেন, সে সমাজের আর্থসামাজিক অবস্থাও একটি বিষয়। ঢাকায় এক ধরনের, গ্রামে অন্য ধরনের।'
আদালতের এই পর্যবেক্ষণ নিয়েও তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে অনলাইন দুনিয়ায়। হাই কোর্টের এরকম পর্যবেক্ষণ কতটুকু সমীচীন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে কেউ কেউ।
আদালতের এ পর্যবেক্ষণের পর অর্থনীতিবিদ ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং-এর (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান এক ফেসবুক পোস্টে প্রশ্ন করেছেন: '"সভ্য" দেশে ছেলেদের পোশাক কেমন হওয়া উচিত?'
সেলিম রায়হানের পোস্টের নিচে অনেকে অনেক রকম মন্তব্য করেছেন। যেমন মেহের আফরোজ লিখেছেন, 'আমাদের অধিকাংশের মতের প্রতিফলন ছিলো এই বিচারিক মন্তব্যে। আমরা যেমন আমাদের বিচারব্যবস্থা ও তেমনই।'
এস ই এস শাহীন লিখেছেন, 'আদালতের কাছ থেকে এমন মন্তব্য আশা করিনি, প্রত্যাশিত নয়।'
এছাড়া আদালতের এ পর্যবেক্ষণের প্রতিক্রিয়ায় লেখক, অনুবাদক মোজাফফর হোসেন এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন: 'পোশাক অবশ্যই সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু সংস্কৃতির মধ্যে বৈচিত্র্যও থাকবে। বিশেষত খাদ্য ও পোশাকের সংস্কৃতির মধ্যে একইসঙ্গে কয়েকটি স্তর থাকে, সবখানেই। এবং পোশাকের সংস্কৃতি সদা পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনশীলতার কারণেই এখানে বোরকা-হিজাব এসেছে, অন্যথায় এই পোশাক আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতির অংশ ছিল না।
'এখন প্রশ্ন হলো শালীনতার। শালীনতার ধারণাটিও আপেক্ষিক ও পরিবর্তনশীল। এক সময় গ্রামে বাড়ির নারীরা পুরুষের পাশাপাশি পুকুরে গোসল করতেন, মায়েরা ব্লাউজ পরতেন না সব সময়। তখন সমস্যা হয়নি, কিন্তু এখন সেটা করতে গেলে শালীনতার প্রশ্ন উঠতে পারে। অনেক সময় নিয়ে সমাজের ভেতর থেকে এই পরিবর্তনগুলো আসে। এখন আদালত দুম করে এগুলো বেঁধে দিতে পারেন কি না সেই প্রশ্নটা চলে আসে। শহরের পোশাক মফস্বলে পরা না গেলে, গ্রামের পোশাক শহরে পরা যাবে কি না? মাননীয় আদালত যদি এই ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়ে দেন, তবে সেটি হবে খুব হতাশার।
তরুণীটি সেদিন যে ধরনের পোশাক পরেছিলেন, সেটি আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে এখন সাধারণ পোশাক। এ নিয়ে আমাদের এত কথা বলতে হচ্ছে, এটা ভাবতেই আমার লজ্জা লাগছে। ওই পোশাককে কোনোভাবেই "আপত্তিকর পোশাক" বলে বেঁধে দিতে পারেন না কেউ, দেশের আদালত তো নয়ই।'
এছাড়া ওই তরুণীর পোশাক নিয়ে হাই কোর্টের মন্তব্যকে দুঃখজনক বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।
বুধবার (১৭ আগস্ট) দেওয়া এক বিবৃতিতে আসক বলে, 'বিভিন্ন গণমাধ্যমে মহামান্য উচ্চ আদালতের বক্তব্য যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে তা যদি সত্য হয় তবে তা নারীর সমানাধিকার, সাংবিধানিক অধিকার, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার মানদণ্ড এবং বর্তমান সরকারের নারীর ক্ষমতায়ন সংক্রান্ত নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়।'
তাছাড়া আদালতের এ ধরনের মন্তব্য প্রতিক্রিয়াশীলদের উদ্বুদ্ধ করবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করে আসক।