লক্ষ্য খাদ্য নিরাপত্তা
খাদ্যপণ্যের চড়া দাম থেকে আর্থিকভাবে দুর্বল জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে বেশকিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার।
চলতি বছরের জুনে বার্ষিক মূল্যস্ফীতি হার ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, ২০১৩ সালের পর যা সর্বোচ্চ। এই অবস্থায় উচ্চ বাজারমূল্য থেকে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েছে সরকার।
এজন্য খোলা বাজারে নিত্যপণ্য বিক্রয় কর্মসূচির (ওএমএস) ব্যাপ্তি বাড়িয়ে প্রতিদিন ৪.৪৪ লাখ পরিবারের মাঝে চাল ও আটা বিক্রি করবে সরকার। এর পাশাপাশি ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর ফ্যামিলি কার্ডধারী এক কোটি পরিবার যেন কম দামে ১০ কেজি করে চাল পান তা নিশ্চিত করবে।
চালের মজুদ বাড়াতে ভারত ও ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশ থেকে চাল আমদানির উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে।
দেশের খাদ্য চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত চাল আমদানি নিশ্চিত করতে বিদ্যমান ২৭.৫% আমদানি শুল্ক ও কর পুরোপুরি প্রত্যাহার করতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে।
এছাড়া, ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধিতে আগামী বোরো মওসুমে উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয়, সেজন্য সেচে ব্যবহৃত ডিজেলের দাম কমানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়, জ্বালানি বিভাগ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে আলোচনা চলছে বলে জানা গেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক সরবরাহ চক্রে যে অভিঘাত সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রভাব অনুভূত হচ্ছে সর্বত্র। বেড়ে গেছে খাদ্যের দাম এবং সমুদ্রপথে জাহাজ ভাড়া। একইসময়, ডলারের বিপরীতে টাকার মান দ্রুতগতিতে কমায়– স্থানীয় বাজারে পণ্যমূল্য আরও বেড়েছে।
ধারাবাহিক এসব ঘটনা দেশের নাগরিকদের খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি করেছে, বিশেষত দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের জন্য।
পরিস্থিতি সঠিকভাবে সামাল দেওয়া নাহলে– বিপুল সংখ্যক মানুষ নতুন করে দারিদ্রসীমার নিচে নেমে যাবে এমন আশঙ্কার কথা গত কয়েক মাস যাবত বলে সতর্ক করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এই বাস্তবতায়, নাগরিকদের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খাদ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছেন।
খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন সোমবার (২২ আগস্ট) দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বর্তমানে সরকার টিসিবির মাধ্যমে এক কোটি পরিবারকে কমদামে সয়াবিন তেল, চিনি ও মসুর ডাল বিতরণ করছে। এখন তাদেরক ১০ কেজি করে চাল দিতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন।সে নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য আমরা ইতোমধ্যে পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছি।
চালের দাম এখনও চূড়ান্ত হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শিগগিরই বিষয়টি চূড়ান্ত করে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবেন। কয় মাস চাল দেওয়া হবে; কত টাকা ভর্তুকি লাগবে; ভর্তুকি অর্থায়নের উৎস কি হবে– তার হিসাবনিকাশ চলছে'- জানান তিনি।
টিসিবির কার্ডধারীদের প্রতি মাসে চাল দেওয়া হবে; নাকি বছরে কতবার দেওয়া হবে– সে বিষয়েও সরকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
খাদ্য সচিব আরও জানান, টিসিবির ডিলারের মাধ্যমে দেওয়া হবে; নাকি খাদ্য অধিদপ্তরের ডিলারের মাধ্যমে দেওয়া হবে– এসব বিষয়ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সম্প্রসারিত ওএমএস
এদিকে, খোলা বাজারে বিক্রয় কর্মসূচি- ওএমএসের আওতায় ১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ টাকা কেজি দরে চাল বিতরণ শুরু করবে খাদ্য মন্ত্রণালয়। আগে এই চালের দাম ছিল ১০ টাকা। খাদ্যবান্ধব এই কর্মসূচির আওতায় প্রায় ৫০ লাখ কার্ডধারী মাসে ৩০ কেজি করে চাল কিনতে পারবে।
এছাড়া, দেশজুড়ে ওএমসের ব্যাপ্তি বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে সারাদেশে প্রায় ৮০০ ডিলারের মাধ্যমে ওএমএসে চাল, আটা বিক্রি হচ্ছে। আগামী মাসে ডিলারের সংখ্যা বাড়িয়ে ২,০১৩টি করা হবে। ওএমএসের দোকান থেকে প্রতিদিন ৪ লাখ ৪০ হাজার জন চাল ও আটা কিনতে পারবেন।
কম দামে আরও চাল
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে চালের পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতির প্রভাব থেকে দরিদ্রদের সুরক্ষায় সরকার খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি সম্প্রসারণের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে জিটুজি (সরকার থেকে সরকার) ভিত্তিতে চাল আমদানির পরিকল্পনা করছে।
তারা বলেছেন, জিটুজি ভিত্তিতে ভিয়েতনাম থেকে চাল আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ভিয়েতনামের বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করবে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
খাদ্য সচিব বলেন, বর্তমানে চালের মজুদ সন্তোষজনক পর্যায়ে রয়েছে। তা সত্ত্বেও প্রয়োজন অনুযায়ী চাল আমদানি করা হবে।
'বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চাল আমদানির বিষয়ে আমাদের এমওইউ (সমঝোতা স্মারক সই) করা আছে'- বলেন তিনি।
মো. ইসমাইল হোসেন জানান, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর গমের মজুদ কমে গিয়েছিল। তবে এখন রাশিয়া থেকে গম আমদানির প্রক্রিয়া চলছে, যা শিগগিরই চূড়ান্ত হবে'।
এছাড়া, বেসরকারি খাতকে যে ১০.১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তার পুরোটাই যেন আমদানি হয়–সেটি নিশ্চিত করতে চাল আমদানির ওপর বিদ্যমান সমুদয় শুল্ককর ও ভ্যাট প্রত্যাহারের যৌক্তিকতা তুলে ধরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি পাঠিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
বর্তমানে চাল আমদানিতে প্রায় ২৭.৫% শুল্ককর রয়েছে বলে জানান খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এটি পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হলে চাল আমদানি বাড়বে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে বলে মনে করছেন তারা। দেশের বাজারে চালের দামও সহনীয় রাখতে ভূমিকা রাখবে।
শুল্ক প্রত্যাহার চেয়ে মন্ত্রণালয়ের চিঠি পাওয়ার পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
চিঠি পাওয়ার কথা টিবিএসকে নিশ্চিত করেছেন এনবিআরের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা। তবে এখনও এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান তিনি।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের নেওয়া এসব উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষণা সংস্থা- সানেম এর গবেষণা পরিচালক সায়েমা হক বিদিশা। তবে সামাজিক নিরাপত্তার এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে, উপকারভোগী চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে আরও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
টিবিএসকে তিনি বলেন, 'এক কোটি পরিবারকে কমদামে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করার উদ্যোগটি আমি ইতিবাচকভাবে দেখব। তবে ভর্তুকি মূল্যের এসব খাদ্যপণ্য যাদের পাওয়ার কথা, তারাই যেন পায়- তা নিশ্চিত করতে হবে'।
এই এক কোটি পরিবারের বাইরেও দেশে অনেক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার রয়েছে, যারা মূলত সীমিত আয় করেন এবং তাদের বড় অংশই শহুরে নিম্ন- মধ্যবিত্ত। চলমান বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায়ই হোক, কিংবা নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করে হোক— উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে তাদেরকে সুরক্ষা দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, এসব নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের আয়ের বড় অংশই ব্যয় হয় বাড়ি ভাড়া ও পরিবহনে। ফলে বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেলে তাদের জীবন নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়ে।
বিদিশা বলেন, চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বেসরকারিখাতের শিল্প মালিকদেরও উচিত, তাদের শ্রমিকদের জন্য কম দামের খাবার নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নেওয়া।
যেমন- একজন গার্মেন্ট মালিক তার শ্রমিকদের জন্য নিজে কিছু টাকা বরাদ্দ করতে পারেন; সেখানে সরকারও কিছু ভর্তুকি দিতে পারে। মালিকপক্ষ ও সরকার মিলে ভর্তুকি দিলে শ্রমিকরা কম দামে খাদ্যপণ্য কিনতে পারবে। এ ধরণের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
চাল আমদানির শুল্ককর প্রত্যাহার প্রস্তাব সমর্থন করে তিনি বলেন, চাল, চিনি, তেলসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর বিদ্যমান শুল্ককর-ও তুলে নেওয়া উচিত।
'এতে সাধারণ ভোক্তারা কিছুটা স্বস্তি পাবে। শুল্ককর প্রত্যাহারের ফলে এনবিআরের যে পরিমাণ রাজস্ব হারাবে– সামান্য সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে অন্যান্য খাত থেকে এর চেয়ে বেশি রাজস্ব আহরণ করতে পারবে'- যোগ করেন বিদিশা।
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি ও চাল আমদানিকারক শহীদুর রহমান পাটোয়ারী টিবিএসকে বলেন, ডলারের দামটা কিছুটা কমায় পরিমাণে কম হলেও চাল আমদানি শুরু হয়েছে।
শুল্ক তুলে দিলে ব্যাপকভাবে আমদানি শুরু হবে এবং বাজারেও চালের দাম কমে যাবে। কারণ ডলারের দাম কমার পাশাপাশি শুল্ক প্রত্যাহারের পর যে খরচ পড়বে– সেটা স্থানীয় বাজারের চালের দামের চেয়ে অন্তত ৬-৭ টাকা কম থাকবে বলে জানান তিনি।
তবে একটা শঙ্কার কথাও তুলে ধরে শহীদুর বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর ভারত গম রপ্তানি বন্ধ করেছে। চাল আমদানির ৯০ শতাংশই যেহেতু ভারত থেকে হয়, সেক্ষেত্রে তারা চালের ওপর আবার নিষেধাজ্ঞা দিলে (আমদানি নিয়ে) জটিলতা তৈরি হবে।