স্যাটেলাইট ছবিতে বাংলাদেশে বন্যার ঝুঁকি বাড়ার ইঙ্গিত
বাংলাদেশে বন্যার ঝুঁকি বাড়ছে, সেইসঙ্গে বাড়ছে বন্যার ঝুঁকিপ্রবণ এলাকায় মানুষের সংখ্যা। স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য-ছবি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এ খবর জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
পেন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়, কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষক সম্প্রতি এ সংক্রান্ত গবেষণা চালিয়েছেন। বন্যাপ্রবণ এলাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি নিশ্চিত হতে গবেষকরা রাতেরবেলা স্যটেলাইটে ধারণকৃত ছবিতে আলো ও ভূমি ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করেছেন।
২০২২ সালের জুনে তারা জানান, বাংলাদেশের মোটামুটি ৭০ মিলিয়ন মানুষ এখন বন্যাপ্রবণ এলাকায় (নদী থেকে ২ কিলোমিটারের মধ্যে) বসবাস করে। এই সংখ্যা ২০০০ সালের তুলনায় প্রায় দেড় মিলিয়ন বেশি। শুধু ঢাকাতেই বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে বাসবাস করে প্রায় ৬ মিলিয়ন মানুষ।
মার্কিন প্রতিরক্ষা আবহাওয়া স্যাটেলাইট প্রোগ্রাম এবং সুওমি-এনপিপি'র উপগ্রহে দৃশ্যমান ইনফ্রারেড ইমেজিং রেডিওমিটার স্যুট (ভিআইআইআরএস)-এর অপারেশনাল লাইনস্ক্যান সিস্টেম (ওএলএস) থেকে গবেষকরা রাতের বেলার চিত্র পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।
বিশেষজ্ঞদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের শহরগুলোর প্লাবনভূমি এলাকায় আলোর ব্যবহার বেড়েছে। এরমধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট এবং ময়মনসিংহের শহরগুলোতে আলোর ব্যবহার বৃদ্ধির সংখ্যা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
গবেষণাটির সহ-লেখক পেন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলবিদ আরিফ মাসরুর বলেন, "বাংলাদেশে নদী থেকে ২ কিলোমিটারের মধ্যবর্তী এলাকায় রাতের বেলা আলো ব্যবহারের মাত্রা ২৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।"
"জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জমির স্বল্পতা, প্লাবনভূমিতে অপরিকল্পিত বসতি স্থাপনে ইন্ধন জোগাচ্ছে। ধান বা মাছ চাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের জন্য অথবা বসবাসের জন্য মানুষ প্লাবনভূমির দিকে চলে যাচ্ছে", যোগ করেন তিনি।
তবে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই রাতের বেলা আলো ব্যবহারের সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি বলে মনে করেন গবেষকরা।
কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলবিদ এবং প্রতিবেদনের আরেকজন সহ-লেখক আশরাফ দেওয়ান ব্যাখ্যা করেন, "এটি অনুমান করা সহজ যে, নদীর ২ কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারী অনেক পরিবারেরই বিদ্যুৎ সংযোগ সুবিধা নেই।"
যদিও ওএলএস এবং ভিআইআইআরএস গ্রামগুলোর সম্পূর্ণ চিত্র নির্ভরযোগ্যভাবেই তুলে ধরতে পারে, তারপরেও এটি মাথায় রাখে হবে- বেশি বিচ্ছিন্ন ঘরবাড়ি বা যেসব বাড়ি খরচ কমাতে বিদ্যুতের ব্যবহার করেনা এবং যেখানে প্রচুর গাছপালা রয়েছে- স্যাটেলাইটের সেন্সর অনেক সময় সেসব বাড়িঘর শনাক্ত করতে পারে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ফলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, স্যটেলাইটে যে তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশে নিঃসন্দেহে তারচেয়ে বেশি মানুষ বসবাস করেন বন্যাপ্রবণ এলাকায়। আর এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
রাজধানী ঢাকা নদী ও বিভিন্ন উপনদী দ্বারা বেষ্টিত। শহরের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা, পশ্চিমে তুরাগ, উত্তরে টঙ্গী খাল এবং পূর্বে রয়েছে বালু নদী।
১৯৮৮ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৫.৭ মিলিয়ন। সেই সংখ্যা বেড়ে বর্তমানে হয়েছে ২২ মিলিয়নের বেশি। ২০০০ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ঢাকার জনসংখ্যার সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণ অনুসারে, বিশেষ করে বুড়িগঙ্গা এবং বালু নদীর তীরে মানুষের বসবাসের মাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।
১৯৮৮ সালের বন্যায় বাজেভাবে জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল ঢাকা শহর, মৃত্যু হয়েছিল ২ হাজারেরও বেশি লোকের। ১৯৯৮ সালের বন্যাও মারা গিয়ছিল ৯০০'র বেশি মানুষ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল সাড়ে ৩ বিলিয়নে।
সম্প্রতি নিচু শহরাঞ্চলের ক্ষণস্থায়ী জলাভূমি খালে, বিলেও বেড়ে চলেছে জনবসতি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব প্লাবন এলাকা মানুষেরে বসবাসের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। মৌসুমি বন্যায় এসব অঞ্চল তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
এ বিষয়ে ভূগোলবিদ আশরাফ দেওয়ান বলেন, "আমরা আশা করছি, গবেষণাটির মাধ্যমে নীতিনির্ধারকরা সমস্যাটির বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা লাভ করবেন। ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে বসতি স্থাপনের এই প্রবণতা চলতে থাকলে আরও বাড়িঘর ধ্বংস হবে এবং আরও মানুষ প্রাণ হারাবেন।"