রাশিয়ার তেল আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আপত্তি নেই
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশ নিশ্চিত হয়েছে যে রাশিয়ার তেল আমদানিতে ওয়াশিংটন আপত্তি করবে না। এ কারণে বাংলাদেশ অচিরেই রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানি শুরু করতে পারে। তবে খুব শিগগিরই তেলের দাম না-ও কমতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বুধবা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আপত্তি নেই।
বুধবার (৩১ আগস্ট) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, 'সম্প্রত্তি যুক্তরাষ্ট্র সফরে আমি মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জোস ডব্লিউ ফার্নান্দেজের সঙ্গে কথা বলেছি। আমি জানতে চেয়েছিলাম রাশিয়া থেকে তেল আমদানিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা আছে কি না। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র তেল, সার ও খাদ্যের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি।
'এ হিসেবে রাশিয়া বা অন্য উৎস থেকে তেল আমদানি করা হলে তাদের আপত্তি থাকার কথা নয়।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা মনে করি জ্বালানি তেল আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সহায়তা করবে।'
রাশিয়া থেকে ৫ লাখ টন গম আমদানিতে সবুজ সংকেত
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ছয় মাস বন্ধ থাকার পর ফের রাশিয়া থেকে শস্য ও সার আমদানি শুরু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
বুধবার সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি খাদ্যের মজুত পূরণ করার জন্য রাশিয়া থেকে ৫ লাখ টন গম আমদানির অনুমোদন দিয়েছে।
এছাড়া রাশিয়া থেকে আরও ১.২০ লাখ টন সার আমদানি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
রাশিয়ার তেলে জ্বালানি সমস্যার সমাধান না-ও হতে পারে
রাশিয়া থেকে তেল আমদানির সম্ভাবনা সম্পর্কে আলোচনাকালে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, রাশিয়া কত দামে তেলে দেবে, তা জানা যায়নি। তাই রাশিয়ার তেল এলেই জ্বালানি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমনটা বলা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞার কারণে পশ্চিমে রাশিয়ার বাজার সংকুচিত হয়ে গেছে। এ কারণে মস্কো সস্তায় তেল বিক্রি করছে।
চীন, ভারত, এমনকি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী সৌদি আরবও রাশিয়ার দেওয়া এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে রাশিয়ার সস্তার তেল কিনছে দেশগুলো। সেইসাথে রুশ তেল পরিশোধন করার পর অনেক বেশি দামে ইউরোপে রপ্তানি করছে।
গত মার্চে বাংলাদেশকেও অপরিশোধিত তেল কেনার প্রস্তাব দেয় রাশিয়া। বাংলাদেশের অপরিশোধিত তেল পরিশোধনের সক্ষমতা না থাকায় মে মাসে মস্কো ঢাকাকে পরিশোধিত তেল কেনার প্রস্তাব দেয়।
গত সপ্তাহে রাশিয়া বিমানযোগে অপরিশোধিত তেলের নমুনাও ঢাকায় পাঠিয়েছে। সেই তেল এখন পরীক্ষার জন্য ল্যাবে আছে।
বুধবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, রাশিয়ান তেলের নমুনা এখন ল্যাব টেস্ট করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, 'টেস্ট রিপোর্টের ভিত্তিতে রুশ তেল আমদানির বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।'
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাশিয়ান অপরিশোধিত তেলের ল্যাব টেস্টের ফলাফল পাওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে এক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে।
এদিকে বাংলাদেশে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল পরিশোধনের সক্ষমতা না থাকায় রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি রোসনেফ্ট অয়েল কোম্পানি ঢাকার কাছে পরিশোধিত তেল বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে মস্কো।
'জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে রাখাই ভালো ছিল'
গত ৫ আগস্ট জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ ডিজেল ও কেরোসিনের দাম সাড়ে ৪২ শতাংশ এবং পেট্রোল ও অকটেনের দাম ৫১ শতাংশ বাড়ায়।
তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ এবং ডিজেলের সব ধরনের আগাম কর প্রত্যাহার করায় সোমবার (২৯ আগস্ট) ভোক্তা পর্যায়ে জ্বালানি তেলগুলোর পুনরায় সমন্বয় করা হয়।
মূল্যবৃদ্ধি এবং জ্বালানির অস্থির বাজার সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, 'জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে রাখাই ভালো ছিল। সামনে কী হবে, জানি না। পাঁচ টাকা কমানো হলো। এটা কত দিন থাকবে কে জানে।'
তিনি আরও বলেন, 'আওয়ামী লীগ সরকার সব সময় জনগণের জন্য উদ্বিগ্ন, সে কারণেই জ্বালানি তেলের দাম ৫ টাকা কমানো হয়েছে।'
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর আগে কর ও শুল্ক পুনর্গঠনের বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, 'এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) শুল্ক-কর উঠিয়ে দিলে জ্বালানি তেলের দাম কমবে। কিন্তু এনবিআর রাজস্ব কোথায় পাবে? রাজস্ব না পেলে উন্নয়ন কীভাবে হবে? শুল্ক কমিয়ে দাম কমানোটা ফিজিবল (লাভজনক) না-ও হতে পারে।'
জ্বালানি তেলের দাম আরও কমার সম্ভাবনার বিষয়ে জানতে চাইলে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, 'এটা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না।'
সেপ্টেম্বর থেকে গম আমদানি শুরু
বাংলাদেশ তুলা, গম, ভুট্টা, সরিষা, মসুর ডাল আমদানি করত রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। দেশে বছরে মোট গমের চাহিদা ৭ মিলিয়ন টন। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ মিলিয়ন টন গম আসত রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে।
ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ওই দুই দেশ থেকে বাংলাদেশের গম আমদানি বন্ধ হয়ে যায়।
তবে বুধবার সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি রাশিয়া থেকে জিটুজি ভিত্তিতে ৫ লাখ টন গম আমদানির অনুমোদন দিয়েছে। আমদানি করা গমের মূল্য চুকানো হবে মার্কিন ডলারে।
প্রতি কেজি গমের আমদানি মূল্য পড়বে ৪০.৮৫ টাকা।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুল বারিক বলেন, রাশিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান এই খাদ্যশস্য সরবরাহ করবে। আর আমদানিকৃত গমের দাম পড়বে টনপ্রতি ৪৩০ ডলার।
৫ লাখ টন গম আমদানিতে মোট খরচ হবে ২ হাজার ৪২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অতিরিক্ত সচিব বলেন, সেপ্টেম্বর থেকে পর্যায়ক্রমে শস্য বাংলাদেশে আসতে শুরু হবে।
বাংলাদেশ কি রাশিয়ার সঙ্গে তেল নিয়ে লাভজনক চুক্তি করতে পারবে?
ভারত, চীন এমনকি সৌদি আরবও সস্তায় রাশিয়ার তেল কিনে লাভবান হচ্ছে। কিন্তু মে মাসে মস্কোর অপরিশোধিত তেল কেনার আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাওয়ার পরও বাংলাদেশ সেই সুযোগ নিতে পারেনি।
এরপর আগস্টে ঢাকাকে পরিশোধিত তেল বিক্রির প্রস্তাবও দেয় মস্কো। এখন রাশিয়ান তেল কোম্পানি রোসনেফ্টের পাঠানো নমুনা পরীক্ষা করছেন কর্মকর্তারা।
কর্মকর্তারা বলেছিলেন, দেশের একমাত্র পরিশোধনাগারে প্রযুক্তিসক্ষমতার ঘাটতি এবং অন্যান্য সরবরাহকারীদের কাছে অগ্রিম বুকিং ছিল রাশিয়ার তেল না কেনার কারণ। তবে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্ভাব্য কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব নিয়েও বিভ্রান্তি ছিল।
গতকাল জ্বালানি উপদেষ্টার বিবৃতিতে রাশিয়ার তেল নিয়ে এসব বিভ্রান্তি দূর করেছে।
বিপিসি বর্তমানে আটটি দেশ থেকে পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে। দেশগুলো হলো—কুয়েত, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভারত।
এদিকে রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে সার কেনার প্রক্রিয়া শুরু হলেও বাংলাদেশ রাশিয়ার গম আমদানির জন্য একটি চুক্তি চূড়ান্ত করেছে।
বেশ কয়েকটি রুশ ব্যাঙ্কের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে এবং বিশ্বব্যাপী লেনদেন নেটওয়ার্ক সুইফট থেকে দেশটিকে বাদ দেওয়ার কারণে পেমেন্ট-সংক্রান্ত সমস্যা ছিল।
গত ১৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাশিয়া থেকে রুবলে জ্বালানি তেল আমদানির উপায় বের করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নির্দেশ দেন।
একনেক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, 'রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ভারত যদি রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করতে পারে, আমরা কেন পারব না?'
তিনি অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংককেও রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি ও রপ্তানির জন্য কারেন্সি সোয়াপ করার জন্য কৌশল প্রণয়নের নির্দেশ দেন।
রাশিয়া থেকে আমদানির জন্য ঋণপত্রের কনফার্মেশনও আরেকটি উদ্বেগের বিষয় ছিল। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গত সপ্তাহে বলেছেন, রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশ থেকে আমদানির জন্য ২৪টি বৈশ্বিক ব্যাংক এলসি কনফার্ম করতে সম্মত হওয়ায় পেমেন্ট নিয়ে এই অনিশ্চয়তাও শেষ হয়েছে।