বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে নানান জটিলতা, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বিতরণ
বিদ্যুৎ খাতকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিলেও বাস্তবায়ন পর্যায়ে বিভিন্ন জটিলতার কারণে সময়মতো অনেক প্রকল্পই শেষ করা যাচ্ছে না।
নকশা প্রণয়ন, ঠিকাদার নিয়োগ, ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা এবং বাস্তবায়ন সক্ষমতার অভাবে বেশ কিছু প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ আটকে আছে। এ কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সফলতা থাকলেও বিতরণ ব্যবস্থায় অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকার অফিস ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ খাতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত ছয়টি প্রকল্পের চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করতে এবং এ সংক্রান্ত ব্যবস্থাগ্রহণ নিয়ে আলোচনার জন্য শনিবার (১০ সেপ্টেম্বর) একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক শুরু হয়েছে।
দুই দিনব্যাপী এই বৈঠকে বিদ্যুৎ বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট বাস্তবায়নকারী সংস্থার প্রতিনিধিরাও অংশ নেবেন।
বাস্তবায়ন কালে সমস্যায় পড়া বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের ৬টি প্রকল্প নিয়ে এই ত্রি-পক্ষীয় বৈঠক আহ্বান করেছে বিশ্বব্যাংক। এসব প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ১.৬৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এছাড়া, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) বিশ্বব্যাংক থেকে ৫৯ মিলিয়ন ডলার ঋণ পাচ্ছে।
সমস্যায় থাকা যে প্রকল্পগুলো নিয়ে আলোচনা, সেগুলো হলো- বাংলাদেশ পাওয়ার সিস্টেমের নির্ভরযোগ্যতা ও দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্প, পূর্বাঞ্চলের পাওয়ার নেটওয়ার্ক বর্ধন ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্প, নবায়ণযোগ্য শক্তি উন্নয়ন প্রকল্প, ঘোড়াশাল ৪র্থ ইউনিট রি-পাওয়ারিং প্রকল্প, গ্রামীণ বিদ্যুতায়ন ও নবায়নযোগ্য শক্তি উন্নয়ন (আরইআরইডি-২) প্রকল্প এবং বিদ্যুৎ বিতরণব্যবস্থা আধুনিকায়ন কর্মসূচি।
বাংলাদেশ পাওয়ার সিস্টেমের নির্ভরযোগ্যতা এবং দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্দেশ্য হল, সরবরাহ কার্যক্রমের অপ্টিমাইজেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ওপর নির্ভরযোগ্যতা এবং এর দক্ষতা উন্নয়ন করা।
বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ ৫ বছর ধরে চললেও প্রকল্পের মূল কাজ এখানও শুরুই হয়নি।
প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এই প্রকল্পের মূল কাজ এখনও শুরু করা সম্ভব হয়নি। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তারা প্রকল্পের নকশা তৈরি করছে। এরপর ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হবে। তবে কবে নাগাদ ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া যাবে , তা বলা যাচ্ছে না। এটি নির্ভর করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাজের ওপর।"
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পিজিসিবির আরেকটি ধীর গতির প্রকল্পগুলো হলো- এনহ্যান্সমেন্ট অ্যান্ড স্ট্রেথেনিং অফ পাওয়ার নেটওয়ার্ক ইন ইস্টার্ন রিজিওন বা পূর্বাঞ্চলের পাওয়ার নেটওয়ার্ক বর্ধন ও শক্তিশালীকরণ। প্রকল্পটিতে বিশ্বব্যাংক সাড়ে ৪০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে।
এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য, পূর্বাঞ্চলের বিদ্যমান গ্রিড নেটওয়ার্কগুলোকে উন্নত ও শক্তিশালী করে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালী অঞ্চলের শিল্প, বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকাগুলোতে বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানো।
পিজিসির তথ্য অনুযায়ী, ৪ বছরে এই প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৪৭.৩০ শতাংশ। এই প্রকল্পের বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণ চুক্তি হয় ২০১৮ সালের মার্চে। আগামী বছর পর্যন্ত রয়েছে এই ঋণ চুক্তির মেয়াদ।
বিশ্বব্যাংকের মতে, এই প্রকল্প ২ লাখ ৭৫ হাজার পরিবার এবং ১৬ হাজার কৃষককে নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করবে এবং বিদ্যুৎ বিভ্রাটও কমাবে। প্রকল্পের আওতায় ১৩টি নতুন সাবস্টেশন নির্মাণ এবং একটি বিদ্যমান স্টেশনের পুনর্বাসনের মাধ্যমে বিদ্যমান গ্রিড নেটওয়ার্ককে প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এদিকে, বিশ্বব্যাংকের ঋণে ফেনী জেলার সোনাগাজীতে ৫০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে বাংলাদেশ ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি (ইজিসিবি) কাজ শুরু করে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে। এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের জুনের মধ্যে।
কিন্তু বাস্তবে সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভূমি উন্নয়নের কাজই এখনও শেষ হয়নি।
১৮৫মিলিয়ন ডলার ঋণে বিশ্বব্যাংকে স্কেলিং-আপ রিনিউয়েবল এনার্জি প্রোজেক্ট বা নবায়নযোগ্য শক্তি উন্নয়ন প্রকল্পের তিনটি অংশের একটি হলো সোনাগাজীর ৫০ মেগাওয়াটের সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা।
প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন জানান, কোভিডের কারণে এই প্রকল্পে বাস্তবায়ন কাজ বিলম্ব হয়েছে।
"আট মাস আগে দরপত্র প্রক্রিয়ার কাজ শেষ করে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রকল্পের নকশার কাজও শেষ হয়েছে। এখন ভূমি উন্নয়নের কাজ চলছে। আগামী বছরে এই কেন্দ্রটি উৎপাদনে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে," যোগ করেন তিনি।
এদিকে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ২১০ মেগাওয়াটের ঘোড়াশাল ৪র্থ ইউনিটকে রি-পাওয়ারিং করে উৎপাদন ৪০৯ মেগাওয়াটে উন্নীত করার কথা ছিল। কিন্তু উৎপাদন বেড়েছে মাত্র ৩০ মেগাওয়াট।
রি-পাওয়ারিংয়ের মূল কাজ শেষ হওয়ার পর ২০২০ সালে কমিশনিং শুরু হয়। এতে দেখা যায়, বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ২৪০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ ১৬৯ মেগাওয়া কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ইপিসি (ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রোকিউরমেন্ট এবং কন্সট্রাকশন) চুক্তিতে স্টিম টারবাইনের কোনো কাজ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। স্টিম টারবাইনের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্থাপন না হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উৎপাদন হচ্ছে না।
আর তাই এখন নতুন করে সংশোধন করা হচ্ছে প্রকল্পটি।
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, চলমান প্রকল্পে বাস্তবায়নে গতি বাড়িয়ে দ্রুত অর্থছাড় নিশ্চিত করা ছাড়াও চুক্তি অপেক্ষায় থাকা প্রকল্প নিয়ে ত্রি-পক্ষীয় সভায় আলোচান হবে।
ইআরডির কর্মকর্তারা আরও জানান, প্রকল্পের প্রস্তুতি না থাকার কারণে বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিশ্চিত করতে সময় লাগে। এ কারণে বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিশ্চিত করতে প্রকল্প প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হবে। পাইপলাইনে থাকা আটটি প্রকল্পকে এবার আলোচনার জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রকল্পগুলো হলো- বে টার্মিনাল প্রোজেক্ট; প্রোগ্রাম অন অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ট্রান্সফর্মেশন ফর নিউট্রিশন, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স; বাংলাদেশ গ্রিন, রেজিলিয়েন্ট অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট পলিসি ক্রেডিট; গ্যাস সেক্টর ইফিশিয়েন্সি ইমপ্রুভমেন্ট অ্যান্ড ডিকার্বোনাইজেশন প্রোজেক্ট।