শিক্ষক, ল্যাব-অবকাঠামো সংকটে নষ্ট হচ্ছে মেডিকেল শিক্ষার মান
২০১৯ সালে ক্লাস শুরু হলেও নীলফামারী মেডিকেল কলেজে কোনো স্থায়ী ক্যাম্পাস নেই, নেই মেডিকেল কলেজের হাসপাতালও।
মেডিকেল কলেজটিতে ফরেনসিক মেডিকেল এবং ফার্মাকোলজির সাবজেক্টের জন্য মাত্র একজন করে লেকচারার আছেন; ওই সাবজেক্টে কোনো অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর বা প্রফেসর নেই। রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে চুক্তিভিত্তিক তিনজন টেকনিশিয়ান সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন নীলফামারী গিয়ে মেডিকেল কলেজের ল্যাব পরিচালনা করেন।
নীলফামারী মেডিকেল কলেজের এক শিক্ষার্থী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ইদের পর আমাদের ফার্মাকোলজি ক্লাস শুরু হওয়ার কথা, তখন টিচার আসবেন বলে আমরা শুনেছি।"
"হাসপাতালের মেডিকেল কলেজ না থাকায় আমাদের ২৫০ বেডের সদর হাসপাতাল থেকেই হয়তো ইন্টার্ন করতে হবে। সদর হাসপাতালে তো সব ধরনের চিকিৎসা হয়না, তাই আমাদের শেখার ঘাটতি থেকেই যাবে," যোগ করেন তিনি।
শুধু নীলফামারী মেডিকেল কলেজই নয়, যশোর, কক্সবাজার, নোয়াখালী মেডিকেল কলেজসহ বেশ কয়েকটি সরকারি মেডিকেল কলেজের হাসপাতাল নেই। অধিকাংশ মেডিকেল কলেজে মানসম্মত ল্যাব নেই। বেশিরভাগ মেডিকেল কলেজেই শিক্ষকের পদ খালি রয়েছে। সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে ৪৯.৭ শতাংশ অ্যাসিসটেন্ট প্রফেসরের পদ খালি রয়েছে বলে জানিয়েছে চিকিৎসা শিক্ষা অধিদপ্তর।
সরকারি মেডিকেলে বেসিক সাবজেক্ট বা মৌলিক বিষয়গুলোতে ১ হাজার ৯৯৭টি পদের মধ্যে ৭২৩টি পদ শূন্য রয়েছে। এরমধ্যে অধ্যাপকের ২০৪টি অনুমোদিত পদের ১৩২টিই পদ শূন্য।
একইভাবে ৩৫২টি সহকারী অধ্যাপক পদের ১৫৬টি, সহযোগী অধ্যাপকের ২৫১টি পদের মধ্যে ৯৪টি শূন্য পদ রয়েছে। এছাড়া, কিউরেটরের ৪৮ পদের মধ্যে ১৬টি, লেকচারার বা প্রভাষকের ১ হাজার ১৩৫টি পদের মধ্যে ৩২৪টি এবং মেডিকেল অফিসারের ৭টি পদের মধ্যে একটি পদ ফাঁকা রয়েছে।
বাংলাদেশে ১০৮টি মেডিকেল কলেজ রয়েছে, যার মধ্যে ৩৮টি সরকারি এবং ৭০টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ। এসব মেডিকেল কলেজের অর্ধেকই ঢাকা বিভাগে।
এক গবেষণা অনুসারে, বর্তমানে বাংলাদেশের চিকিৎসা শিক্ষার মান আশানুরুপ বলে মনে করেন ৬৮.৪ শতাংশ বিশিষ্ট নাগরিক। তারা মনে করেন, আমরা যদি মানস্মমত চিকিৎসক তৈরি করতে না পারি, তাহলে যত সুন্দর অবকাঠামোই থাকুক না কেনো মানসম্মত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবেনা। 'বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত: বর্তমান চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যতের নির্দেশিকা' শীর্ষক গবেষণায় এ কথা বলেন তারা।
বাংলাদেশের মেডিকেল শিক্ষা, স্বাস্থ্যখাতের টারশিয়ারি পর্যায় থেকে কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যন্ত বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের জন্য ২০২১ সালের ১১ মার্চ থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত বরেণ্য চিকিৎসক, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকসহ ৬০ জন বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে ১১ পলিসি ডায়ালগের মাধ্যমে বিজ্ঞানভিত্তিক সুপারিশ গ্রহণ করা হয়।
সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডাঃ এএফএম রুহুল হক, বেসরকারি সংস্থা এমিনেন্স অ্যাসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের সহযোগিতায় গত বছর গবেষণাটি পরিচালনা করেন এবং ২০ মার্চ ২০২২ তারিখে প্রকাশ করেন প্রতিবেদনটি।
গবেষণায় বলা হয়, সকল মেডিকেল কলেজে প্রয়োজনীয় শিক্ষক সংকট রয়েছে। ৪৬.৭ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মনে করেন, শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি ও তাদের পদন্নতি পুনর্গঠন করতে হবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মান সাধারণ মানুষেরন দোড়গোড়ায় পৌঁছে দিতে স্বাস্থ্য শিক্ষাকে ঢেলে সাজানোর পক্ষে মত দেন ৮১ শতাংশ অংশগ্রহণকারী।
স্বাস্থ্য শিক্ষাকে ক্লিনিক্যাল স্বাস্থ্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপক স্বাস্থ্য শিক্ষা, রোগ-প্রতিরোধ স্বাস্থ্য শিক্ষা ও চিকিৎসা শিক্ষক স্বাস্থ্য শিক্ষা- এই চারভাগে ভাগ করার পরামর্শ দেওয়া হয় গবেষণায়।
যুগোপযোগী নয় মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থা
মেডিকেল কলেজের শিক্ষকরা বলেন, বর্তমান চিকিৎসা শিক্ষা এখনকার মহামারি সংক্রান্ত পরিবর্তন ও রোগের ধরণভিত্তিক নয়।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ রিজওয়ানুল করিম টিবিএসকে বলেন, "আমাদের মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থা নিরাময়মূলক ও প্রতিরোধমূলক নয়। এখন অসংক্রামক রোগ বাড়ছে, এর ফলে মানুষের খরচ ৬৭ শতাংশ বেড়ে গেছে।"
তিনি আরও বলেন, "যারা শিক্ষক তারাও আধুনিক কারিকুলামের সঙ্গে যুক্ত নয়, শিক্ষকরাও গুণগত মান সমৃদ্ধ নয়, শিক্ষক ও অন্যান্য জনবলে ঘাটতি রয়েছে; আধুনিক ল্যাব নেই। মানসম্মত প্রাকটিক্যাল শিক্ষা ছাড়াই কম দক্ষ শিক্ষার্থী বের হচ্ছে। নতুন নতুন মেডিকেল কলেজ তৈরি না করে, পুরোনো বড় বড় মেডিকেল কলেজের সিট বাড়াতে হবে। তাহলে মানসম্মত ডাক্তার বের হবে।"
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বেসিক সায়েন্স অ্যান্ড প্যারাক্লিনিক্যাল সায়েন্স অনুষদের সাবেক ডিন এম ইকবাল আর্সলান টিবিএসকে বলেন, "প্রশাসনিক আদেশে যে হারে মেডিকেল কলেজ তৈরি হচ্ছে, সেই তুলনায় শিক্ষক তৈরি হচ্ছে না। তাই শিক্ষক ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। পুরোনো বড় বড় মেডিকেল কলেজ ছাড়া অধিকাংশ নতুন সরকারি ও প্রাইভেট মেডিকেল কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীরা রোগী পায়না, শিক্ষার মানও যথেষ্ট নয়।"
"এসব মেডিকেল থেকে যে চিকিৎসক বের হচ্ছে, তারা শুধু পুথিগত শিক্ষা পাচ্ছে; প্রাকটিক্যাল শিক্ষা পাচ্ছেনা," যোগ করেন তিনি।
৩৬ শতাংশ শিক্ষকের পদ খালি
চিকিৎসা শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে বেসিক সাবজেক্ট এনাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিট্রি, ফার্মাকোলজি, কমিউনিটি মেডিসিন, মাইক্রোবায়লোজি, ফরেনসিক মেডিসিন ও ভাইরোলজি ডিপার্টমেন্টে বর্তমানে ৩৬ শতাংশ শিক্ষকের পদ খালি রয়েছে।
তবে নীলফামারী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডাঃ রবিউল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, মেডিকেল কলেজগুলোতে বেসিক সাবজেক্টের শিক্ষক সংকট এখন কিছুটা কেটেছে।
যশোরে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দাবিতে সুশীল সমাজ
যশোরে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ১১ বছর পেরিয়ে গেছে। তবে এখনো মেডিকেল কলেজের জন্য অত্যাবশ্যকীয় হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা হয়নি। যশোর মেডিকেল কলেজের সঙ্গে ৫০০ বেডের হাসপাতাল চালুর জন্য গত বছরের অক্টোবর থেকে আন্দোলন করছেন যশোরের স্থানীয় মানুষ।
যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব জিল্লুর রহমান ভিটু টিবিএসকে বলেন, "আমাদের মেডিকেল কলেজের স্টুডেন্টরা বই পড়ে শিখছে কিন্তু তারা তো রোগী দেখে প্রাকটিক্যালি শিখছে না, কারণ সদর হাসপাতালে জটিল রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়না।"
ভিটু আরও বলেন, "কোভিডের সময় আমরা নন-কোভিড রোগীদের ভোগান্তী দেখেছি। তাই যশোরের সচেতন নাগরিকরা মিলে আমরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করেছি। গত এক বছর ধরে এ কমিটি মানববন্ধন, রাস্তা অবরোধ, প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেওয়া, গণস্বাক্ষর কর্মসূচিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।"
প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে সংকট বেশি
৫০ সিটের একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ২৫০ বেডের আধুনিক হাসপাতাল থাকা বাধ্যতামূলক। তবে বেসরকারি অনেক মেডিকেল কলেজেই শর্ত মেনে হাসপাতাল নেই। শিক্ষক সংকট, আধুনিক শিক্ষা সরঞ্জামেরও অভাব রয়েছে।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের নীতিমালা অনুযায়ী কার্যক্রম না চালানোর জন্য রেজিস্ট্রেশন বাতিলের পরও হাইকোর্ট থেকে রিট করে শিক্ষার্থী ভর্তি ও কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে কয়েকটি মেডিকেল কলেজ। তবে, মেডিকেল কার্যক্রম চালু থাকলেও সেসব শিক্ষার্থীর ইন্টারশিপ নিয়ে এখন জটিলতা শুরু হয়েছে।
এরমধ্যে ইন্টারশিপের জন্য মাইগ্রেশনের দাবিতে আন্দোলন করছে কেয়ার মেডিকেল কলেজের ২০১৫-২০১৬ সেশনের নতুন পাশ করা চিকিৎসকরা।
চিকিৎসা শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডাঃ একেএম আমিরুল মোরশেদ টিবিএসকে বলন, "আমাদের মেডিকেল শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে প্রাইভেটে মেডিকেল কলেজ নিয়ে সমস্যা আরও বেশি। অনেক মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা রোগী পায়না। ফলে তারা ভালোভাবে শিখছে না।"
তিনি আরও বলেন, "কোন প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ ভালো, কোনটির কি কি ঘাটতি আছে তা লাল কালিতে চিহ্নিত করে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েব সাইটে তুলে দেওয়ার কাজ করা হচ্ছে। যাতে করে অভিভাবকরা ছেলে-মেয়েদের ভর্তি করানোর আগেই জানতে পারে কোনটি ভালো আর কোনটি খারাপ এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়।"
৭২টি বেসরকারি মেডিকেলের মধ্যে চলতি আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা বিভাগের ৩৩টি, চট্টগ্রামের ১০টি, রাজশাহীর ৬টি, খুলনা ও সিলেটের ৪টি এবং রংপুরের একটিসহ মোট ৫৮টি কলেজ শিক্ষকের তথ্য দিয়েছে। বাকি ১২টি তথ্য দেয়নি।
৫৮ বেসরকারি কলেজে ৮৯০ জন অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ৮৯৫ জন, সহকারী অধ্যাপক ৭৯৯ জন, কিউরেটর ৭৩ জন এবং ১ হাজার ৯৬৮ প্রভাষকসহ ৪ হাজার ৬২৬ জন শিক্ষক রয়েছেন।
বেসরকারি মেডিকেলে ৯ হাজার শিক্ষকের দরকার রয়েছে। কিন্তু আছে ৪ হাজার ৬২৬ জন।
মেডিকেল শিক্ষার মানোন্নয়ে স্বাস্থ্য-শিক্ষা কতৃপক্ষ যা করছে
ডাঃ একেএম আমিরুল মোরশেদ বলেন, মানসম্মত মেডিকেল শিক্ষা নিশ্চিত করতে মানসম্মসত শিক্ষক প্রয়োজন।
"শিক্ষকদের মান উন্নয়নের জন্য আমরা শিক্ষদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করছি। এছাড়া মেডিকেল অবকাঠামো এখন তৈরি হচ্ছে। মেডিকেল কারিকুলাম রিভাইজ করা হয়েছে, শিগগিরই নতুন কারিকুলাম চালু হবে," বলেন তিনি।
"দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতি না থাকায় শিক্ষক সংকট তীব্র হয়েছে। আগামী সপ্তাহে পদোন্নতি সংক্রান্ত মিটিং হবে। আশা করি, দ্রুতই পদোন্নতি হবে এবং শিক্ষক সংকট কমে যাবে," যোগ করেন ডাঃ একেএম আমিরুল মোরশেদ।