সুনামগঞ্জের এক উপজেলা যেভাবে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠল!
সুনামগঞ্জ জেলা শহরের সবচেয়ে কাছের উপজেলা বিশ্বম্ভরপুর। দূরত্ব মাত্র ১২ কিলোমিটার। তবু এতোদিন অবহেলিত আর অনুন্নত অবস্থায় পড়েছিলো এ উপজেলা। সুনামগঞ্জের অন্য উপজেলাগুলোর মতো বিশ্বম্ভরপুরও হাওরবেষ্টিত। তবে এখানে যেতেন না কোন পর্যটক। পর্যটকদের আকর্ষণের জন্যও ছিলো না তেমন কিছু।
তবে এক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার উদ্যোগে বদলে গেছে বিশ্বম্ভরপুর। হয়ে উঠেছে জেলার অন্যতম পরিপাটি ও পর্যটক আকর্ষণীয় উপজেলায়।
অবহেলিত বিশ্বম্ভরপুরই গত দেড়-দুই বছরে নান্দনিক রূপ নিয়েছে। বিভিন্ন মোড়ে নির্মাণ করা হয়েছে চমৎকার সব স্থাপনা। কৃষাণ চত্বর, বোয়াল চত্বর, জয়বাংলা চত্বর, হাওরবৃত্ত চত্বর- এমন সব স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে উপজেলা জুড়ে। পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে- হাওর বিলাস ও পাহাড় বিলাস নামে আরও দুটি নান্দনিক স্থাপনা। হাওর আর পাহাড় দেখতে এই দুই জায়গায় এখন পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে।
বিশ্বম্ভরপুরের ভাস্কর্য আর স্থাপনাগুলো সুনামগঞ্জের ইতিহাস আর ঐতিহ্যকেই তুলে ধরছে জানিয়ে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী সুনামগঞ্জ জেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এখানকার স্থাপনাগুলো সুনামগঞ্জকেই উপস্থাপন করছে। সুনামগঞ্জের হাওর, ধান, মাছ, কৃষক এসব তুলে ধরা হয়েছে স্থাপনায়।
তিনি বলেন, 'জেলা শহরের পাশ্ববর্তী হলেও বিশ্বম্ভরপুর ছিলো সুনামগঞ্জের সবচেয়ে অবহেলিত উপজেলা। অন্য জেলার মানুষ টাঙ্গুয়ার হাওরের জন্য তাহিরপুরকে চেনে। শিল্পকারখানার জন্য ছাতককে চেনে। কিন্তু বিশ্বম্ভরপুরের কোন পরিচিতি ছিলো না। এসব স্থাপনা নির্মাণের কারণে মানুষজন এখন বিশ্বম্ভরপুরকে চিনছে। অনেক পর্যটক এখানে বেড়াতে আসছেন।'
এমন উদ্যোগকে ইতিবাচক উল্লেখ করে এই সংস্কৃতিকর্মীর দাবি, প্রত্যেক উপজেলায় এমন উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
জানা যায়, স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাদি উর রহিম জাদিদের উদ্যোগেই বদলে যাচ্ছে বিশ্বম্ভরপুর। ২০২০ সালে বিশ্বম্ভরপুরের ইউএনও হিসেবে যোগ দেন জাদিদ। এরপর থেকেই উপজেলার সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও পর্যটক আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন তিনি।
স্থানীয় সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহও জানালেন এমনটি। তিনি বলেন, 'এখানকার ইউএনও খুব কর্মঠ। তিনিই আমাদের সাথে কথা বলে এসব সুন্দর স্থাপনাগুলো নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন। ফলে এখন বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার চেহারা বদলে গেছে।'
পীর ফজলুর রহমান বলেন, যেসব জায়গায় বিভিন্ন ভাস্কর্য ও স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে এগুলো আগে বেদখল হয়ে ছিলো। ময়লার ভাগাড় ছিলো। এসব উচ্ছেদ করেই স্থাপনাগুলো নির্মাণ করা হয়েছে।
উপজেলার ছিলাকান্দি বাজারে মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর্য নামে আরেকটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
বিশ্বম্ভরপুরের কারেন্টের বাজারে নির্মিত একটি ভাস্কর্য দৃষ্টি কাড়বে যে কারো। বাজারের মোড়ে নির্মাণ করা হয়েছে বোয়ালের ভাস্কর্য। এই চত্বরের নামও এখন বোয়াল চত্বর।
হাওর বেষ্টিত সুনামগঞ্জ মাছের জন্যও প্রসিদ্ধ। হাওরের বোয়াল মাছের বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। ভাস্কর্যের মাধ্যমে সেই খ্যাতিই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
উপজেলার চালবন মোড়ে নির্মাণ করা হয়েছে কৃষাণের ভাস্কর্য। উঁচু স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে থাকা এই কৃষকের মাথায় বেতপাতার ছাতা, হাতে লাঠি, আর ভাঁজ করে পরা লুঙ্গি- কৃষকেরা যেমন পড়ে থাকেন। এই মোড়ের নামই এখন কৃষাণের চত্বর।
এই ভাস্কর্য দেখিয়ে সিলেট থেকে বেড়াতে আসা শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নিলয় হাসান বললেন, 'সিলেট নগরেও এমন ভাস্কর্য নেই। বরং মৌলবাদীদের কারণে সিলেট নগর বা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস্কর্য নির্মাণ করা যায় না। এরকম সুন্দর কিছু করার উদ্যোগও নেই। অথচ হাওর পাড়ের এই গ্রামীণ প্রায় এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে এমন চমৎকার ভাস্কর্য।'
এছাড়া উপজেলা পরিষদ ভবনের পাশে 'হাওর বিলাস' ও মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে 'পাহাড় বিলাস' নামে দুটি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে রয়েছে উঁচু ওয়াচ টাওয়ারে উঠে হাওর ও পাহাড় দেখার সুবিধা। ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য রয়েছে দৃষ্টিনন্দন ফুড কোর্ট, বিশ্রামাগার।
উপজেলাকে এমন নান্দনিক রূপ দেয়া ইউএনও মো. সাদি উর রহিম জাদিদ বলেন, 'আগে পুরো উপজেলা জুড়ে অব্যবস্থাপনা ছিলো। বাজারগুলো ছিলো ঘিঞ্জি আর ময়লা-আবর্জনায় ভরা। বিশেষত সরকারি জায়গা দখল করে পার্কিং আর দোকান করা হয়েছিলো।'
তিনি বলেন, 'আমি এখানে যোগ দেয়ার পর এইগুলাকে একটা ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসার কাজ শুরু করি। প্রথমে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করি। এরপর সৌন্দর্য বর্ধন ও বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নেই। আগে এখানে বিনোদনের কোন সুযোগ ছিলো না। জেলার টাঙ্গুয়ার হাওর ছাড়া বেড়ানোর আর ভালো কোন জায়গাও ছিলো না। এখন বিশ্বম্ভরপুরেও অনেকে বেড়াতে আসেন।'
এসব স্থাপনা নির্মাণে স্থানীয় সংসদ সদস্য, বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক অনেক সহযোগিতা করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, 'তাদের কাছে থেকে অর্থ সহায়তাও পেয়েছি। এছাড়া উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন ফান্ডের টাকাও এসব নির্মাণে ব্যবহার করেছি। তবে খুব বেশি টাকা খরচ হয়নি। সবমিলিয়ে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।'
এলাকার মানুষজনও এসব কাজের প্রশংসা করছেন জানিয়ে ইউএনও বলেন, 'বিভিন্ন ভাস্কর্য নির্মাণে আমরা কোন বাধা পাইনি। বরং হাওর বিলাস করার পর সবাই খুব প্রশংসা করছে। এখন মানুষজন বিভিন্ন জায়গায় এমন স্থাপনা চায়। তাছাড়া এখানে উগ্রতা নেই।'
সকলের সহযোগিতায় সুনামগঞ্জের সবচেয়ে অবহেলিত ও অপরিচ্ছন্ন উপজেলা থেকে বিশ্বম্ভরপুর এখন অন্যতম আকর্ষণীয় উপজেলা হয়ে উঠেছে বলে জানান শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দেওয়া এই ইউএনও।
ইউএনও জানান, বোয়াল চত্বর নির্মাণ করেছেন শিল্পী জালাল সরকার, জয় বাংলা ও কৃষাণ চত্বরের শিল্পী নাইম দিপু এবং হাওর বৃত্তের নকশা করেছেন প্রকৌশলী জিষ্ণু কুমার দাস।'
সাংবাদিক উজ্জ্বল মেহেদীর বাড়ি সিলেটের সুনামগঞ্জে। উপজেলায় এমন উদ্যোগের প্রশংসা করে তিনি বলেন, 'জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তা আন্তরিক হলে যে একটি উপজেলাকে বদলে দিতে পারেন তার বড় উদহারণ বিশ্বম্ভরপুর। ইউএনও'র উদ্ভাবনী ও সৃষ্টিশীল চিন্তা আর স্থানীয় সংসদ সদস্যের সহযোগিতায় বিশ্বম্ভরপুর এখন আমূল পাল্টে গেছে। এসবের জন্য আলাদা কোন অর্থ বরাদ্দেরও প্রয়োজন হয়নি।'
উজ্জ্বল বলেন, 'জেলার মধ্যে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায়ই ছিলো সবচেয়ে উপেক্ষিত ও অবহেলিত। কোন কিছুই ছিলো না এখানে। সেই বিশ্বম্ভরপুরই এখন হয়ে উঠেছে হাওর পর্যটনের অন্যতম বড় ক্ষেত্র।'