মিয়ানমারের গোলা: আতঙ্কে হাজার কৃষক, পাহাড়ে নষ্ট হচ্ছে জুমের ফসল
'জুমে লাগানো ধান গাছে ফসল আসতে শুরু করেছে। কিন্তু গত একমাস ধরে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গোলা বর্ষণের কারণে জুমে যাওয়া যাচ্ছে না। এখন যদি জুমে সার ও নিড়ানি দেওয়া না যায় তবে জুমের ফসল জুমেই নষ্ট হবে। আর ফসল না পেলে ছেলেমেয়েকে নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।'
বুধবার দুপুরে অশ্রুসজল চোখে কথাগুলো বলছিলেন বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন ঘুমধুমের বাসিন্দা সাকি মং।
মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মি (এএ) ও মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) মধ্যে চলমান সংঘর্ষের জেরে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে সীমান্তবর্তী ঘুমধুম ইউনিয়নসহ আশেপাশের এলাকায়। মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণের কারণে জুমসহ বিস্তীর্ণ ফসলের জমিতে যেতে পারছেন না হাজারো কৃষক, যার প্রভাব পড়েছে স্থানীয় জীবন ও জীবিকায়।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এ কে জাহাঙ্গীর আজিজ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ৩৪৭ হেক্টর পাহাড়ের ঢালু জমিতে চাষসহ আবাদ করা হয়েছে মৌসুমি জুমসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফসল। সীমান্ত এলাকার কৃষি জমিতে উৎপাদিত ধানসহ বিভিন্ন মৌসুমি সবজি বান্দরবান-কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়। এছাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোর চাহিদাও মেটানো হয় এ এলাকার ফসল থেকে।'
'গোলাবর্ষণের কারণে জুমসহ ফসলের কোন ফলন ঘরে তুলতে বা বাজারজাত করতে পারছে না সীমান্ত এলাকার কৃষকরা। এতে অর্থনৈতিকভাবে সংকটে পড়েছে এসব কৃষক পরিবারসহ সাধারণ মানুষ। এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে সীমান্ত এলাকায় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে', বলেন এ কে জাহাঙ্গীর আজিজ।
বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের সঙ্গে প্রায় ১৫ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। তমব্রু সীমান্ত থেকে বাইশপারী সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে ঢুকে গেছে মিয়ানমারের ভেতর।
এই তিন কিলোমিটারসহ পুরো সীমান্ত এলাকা জুড়েই কয়েক হাজার হেক্টর জমি ও পাহাড়ে ধানসহ নানান ফসলের আবাদ করেছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও বাঙ্গালি কৃষকেরা। কিন্তু মিয়ানমারের তমব্রু অংশটি মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) নিয়ন্ত্রণাধীন থাকলেও মিয়ানমার অংশের বাইশপারী এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মি (এএ)।
বর্তমানে দুই পক্ষই নিজ নিজ অবস্থান থেকে দিনে-রাতে মর্টারশেল ও গুলি বিনিময় করছে। ফলে গোলা আতঙ্কে দীর্ঘদিন ধরে কৃষকরা জুমে ও ফসলের জমিতে যেতে না পারায় ফসল নষ্ট হচ্ছে। বাইশপারী সীমান্তের মিয়ানমার অংশের একটি পাহাড়ের বেশ বড় একটা অংশ ভস্মীভূত হয়ে গেছে মিয়ানমার সেনাদের ছোঁড়া গোলার আঘাতে। এর ঠিকপাশেই বাংলাদেশ অংশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের গ্রাম।
ঘুমধুম সীমান্তের বাইশপারী এলাকার এক কৃষক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে জুমে চার লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছি। আগামী একমাসের মধ্যে ফসল ঘরে তুলতাম, কিন্তু এখন পাহাড়েই যেতে পারছিনা। মিয়ানমারের সেনারা কখনো স্থল থেকে গোলা ছুঁড়ে, কখনো হেলিকপ্টার থেকে।'
এর আগে গত ১৬ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুম ইউনিয়নের তমব্রু সীমান্তে মিয়ানমারের স্থাপন করা স্থলমাইন বিস্ফোরণে পা হারায় বাংলাদেশি যুবক অংঞাথোয়াই তঞ্চঙ্গ্যা (২২)। একইদিন একই এলাকার নিকটবর্তী সীমান্তের জিরো পয়েন্টে মিয়ানমারের ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে এক রোহিঙ্গা যুবক নিহত হয়, আহত হয় আরও পাঁচ নারী-শিশু।
তমব্রু এলাকার হেডম্যান (মৌজা প্রধান) তাইঞ্জা প্রু তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, 'আমাদের হেডম্যান পাড়ার অধিকাংশ বাসিন্দা কৃষিজীবী। শুক্রবারের ঘটনার পর থেকে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ভর করেছে। কৃষিজমিতে তো নাই, গরু আনতেও কেউ জমিতে যাচ্ছে না।'
আমতলী এলাকার বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন চার বিঘা পাহাড়ি জমির মালিক নুরুল হাকিম। তিনি বলছিলেন, 'সীমান্তঘেঁষা জমিগুলোতে পাহাড়ি-বাঙ্গালি মিলে প্রায় এক হাজার কৃষকের চাষাবাদ আছে। যেখানে ধান ও সবজির আবাদের জন্য কয়েক কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন কৃষকরা। কিন্তু গোলার আতঙ্কে কৃষকরা জমিতে নামতে পারছেন না। জমিতে যেতে না পারার কারণে তাদের আবাদকৃত ফসল কেমন আছে তাও জানতে পারছেনা।'
জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক ইয়াসমিন পারভীন তিবরিজি টিবিএসকে বলেন, 'সীমান্তে মানুষের মধ্যে যে আতংক কাজ করছে সেজন্য সরকার তাদের পাশে আছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও জুমিয়া পরিবারগুলোকে সরকারিভাবে সহযোগিতা দেয়া হবে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছেন।'