গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট ছাড়াই চলছে সরকারি হাসপাতাল
একজন চিকিৎসক রোগীর অসুস্থতা নির্ণয় এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। অন্যদিকে, একজন নার্স যত্ন নেন রোগীর। কিন্তু হাসপাতালে একজন ফার্মাসিস্টের কাজ কী? তিনি ঠিক কী করেন?
রোগীর প্রেসক্রিপশন মনিটর-ফলোআপ করা, ওষুধের অপব্যবহার রোধ, ওষুধের নিরাপদ সংরক্ষণ হলো একজন ফার্মাসিস্টের প্রধান কাজ, যা বিস্তৃত স্বাস্থ্যসেবা খাতে অপরিহার্য। এ কারণেই বিশ্বের প্রায় সব দেশে ডাক্তার ও ফার্মাসিস্টদের কাজের এমন সমন্বয়েই রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। ফলে রোগীও পান মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা।
আমাদের দেশের এ গ্রেড কয়েকটি প্রাইভেট হাসপাতালে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট থাকলেও সরকারি হাসপাতালে এখন পর্যন্ত কোনো পদ নেই।
দীর্ঘদিন ধরে সরকারি হাসপাতালে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কয়েক দফা নির্দেশনা জারি করলেও এখনও তা বাস্তবায়িত হয়নি। তবে স্বল্প সময়ের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে দেশের প্রতিটি হাসপাতালে গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শাহ আমরান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ডাক্তার রোগীকে কোনো ওষুধ দিলে সেটির ডোজ আছে ঠিক কিনা, তার অলটারনেটিভ কম দামের ওষুধ রোগীকে দেওয়া যায় কিনা, তা ঠিক করতে পারে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট।"
"বর্তমানে সব কাজের স্পেশালাইজেশন হয়েছে। ডাক্তারের কাজ ডাক্তার, ফার্মাসিস্টের কাজ ফার্মাসিস্ট এবং নার্সের কাজ নার্স করেন। কিন্তু বাংলাদেশে ডাক্তাররাই যদি ফার্মাসিস্টের কাজ করেন, তাহলে তো রোগী যথাযথ সেবা থেকে বঞ্চিত হয়," যোগ করেন তিনি।
"ওষুধের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার রোধে হাসপাতালে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট প্রয়োজন। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট, নার্স ও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট প্রয়োজন হয়। স্বাস্থ্যসেবায় হসপিটাল ফার্মাসিস্ট না থাকা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল দশার একটি কারণ," বলেন তিনি।
অধ্যাপক ড. শাহ আমরান আরও বলেন, "পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে ফার্মেসিকে ক্যাডার সার্ভিসের আওতায় আনতে হবে এবং হাসপাতালগুলোতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দিতে হবে। তারাও বিসিএস দিয়ে নবম গ্রেডের চাকরিতে ঢুকবে। তাহলে স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নত হবে। তা না হলে, যাদের ন্যূনতম টাকা আছে তারাই বিদেশে যাবে চিকিৎসার জন্য।"
বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে মোট ৪১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি বিষয়টি পড়ানো হয় এবং সেখান থেকে প্রায় চার হাজার গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট প্রতি বছর পাস করে বের হন। তাদের একটি বড় অংশ ওষুধ শিল্পে কাজ করেন, বাকিরা অন্য পেশায় চলে যান বা বেকার থাকেন।
গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের মূল কর্মক্ষেত্র হাসপাতাল ফার্মেসি সার্ভিস, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি সার্ভিস ও রিটেইল ফার্মেসি সার্ভিসে তাদের নিয়োগ দিলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
নভো হেলথকেয়ার অ্যান্ড ফার্মা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ ফরিদউদ্দিন কাওসার খান টিবিএসকে বলেন, "ফার্মাসিস্ট সম্পর্কে আমাদের একটি ভুল ধারণা রয়েছে; আমাদের দেশে মনে করা হয়, ফার্মাসিস্ট তারাই যারা ডিপ্লোমা করেন এবং ওষুধ কিনে ওষুধের মজুদ রাখেন। প্রকৃতপক্ষে, ফার্মাসিস্ট বলতে বোঝায় যারা গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট।"
"গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা ফার্মেসি কাউন্সি থেকে এ গ্রেড ফার্মাসিস্টের সার্টিফিকেট নেন। এ গ্রেড ফার্মাসিস্টের পোস্ট কোনো সরকারি হাসপাতালে নেই। ১৯৯৩ সালে সরকারি হাসপাতালে ১০ জন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনো তা বাস্তবায়িত হয়নি," যোগ করেন তিনি।
ফরিদউদ্দিন কাওসার খান বলেন, "হসপিটাল ফার্মাসিস্টরা শুধু ওষুধ নিয়ে কাজ করেনা। তারা রোগীর প্রত্যেকটা প্রেসক্রিপশন মনিটর করবে, ফলোআপ করবে, কোনো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে কিনা, কোনো নির্দিষ্ট ওষুধের মডিফিকেশন হচ্ছে কিনা্-এ ধরনের কাজ তারা করবে।"
"একজন ডাক্তারের ওষুধ সম্পর্কিত জটিলতার বিষয়ে ধারণা নেই। রোগীকে প্রেসক্রিপশন লিখে দেওয়ার পর তার ডোজের কোনো কম বেশি হলে তা সমন্বয় করতে পারে ফার্মাসিস্ট। সরকারি হাসপাতালে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নেই, ফলে আর্থিক ও শারিরীক ক্ষতি হচ্ছে রোগীদের," বলেন তিনি।
বাংলাদেশে এভারকেয়ার, স্কয়ার হাসপাতালের মত এ গ্রেডের প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে হসপিটাল ফার্মাসিস্ট আছে। এসব হাসপাতালে ডাক্তার রোগী দেখার সময় বা প্রেসক্রিপশন করার সময় ফার্মাসিস্টরা পরামর্শ দিতে পারেন।
সরকারি হাসপাতালগুলোর আউডোরে একজন ও ইনডোরে ৫০ রোগীর বেডের বিপরীতে মাত্র একজন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২০২০ সালে দুটি প্রজ্ঞাপন জারি করে, যেখানে স্বতন্ত্র ফার্মেসি সেবা পরিদপ্তর/অধিদপ্তর গঠন, কার্যপরিধি নির্ধারণ ও ফার্মাসিস্টদের নিয়োগের জন্য নির্দেশনা ছিল।
বাংলাদেশের ফার্মেসি কাউন্সিলের সচিব মুহাম্মদ মাহবুবুল হক টিবিএসকে বলেন, "ওষুধের যৌক্তিক ও নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দেওয়ার পাশাপাশি মডেল ফার্মেসিগুলোতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দিলে মানুষ পরিপূর্ণ সেবা পাবে। সরকার এতে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এ বিষয়ে আরও আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন।"
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সামিউল ইসলাম সাদী জানান, সরকারি হাসপাতালে ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দেওয়ার আবেদন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। সেখানে সব প্রক্রিয়া শেষে স্বল্প সময়ের মধ্যেই এই পদে লোক নিয়োগ দেওয়া হবে।
প্রাথমিকভাবে প্রায় ৬০০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে বলে জানান তিনি। এরপর পদ খালি থাকলে আরো লোক নিয়োগ দেওয়া হবে।
আজ ২৫ সেপ্টেম্বর বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য 'ফার্মেসি স্বাস্থ্যকর বিশ্বের জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ'। প্রতিপাদ্যের উদ্দেশ্য হলো, কীভাবে ফার্মেসি পেশাদাররা সারা বিশ্বে মানুষের সুস্বাস্থ্য এবং মঙ্গলের জন্য কাজ করছেন তা তুলে ধরা।