সঞ্চালন ব্যবস্থা নিয়ে অবহেলার কারণে বারবার বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটছে: বিশ্লেষকদের মত
গ্রিড বিপর্যয়ে মঙ্গলবার দীর্ঘ সময়ের জন্য দেশের বেশ কিছু অঞ্চল বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকার মূল কারণ এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলেও বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা উন্নত ও আধুনিক না করার কারণেই বারবার এ ধরনের বিপর্যয় ঘটছে।
মঙ্গলবারের ব্ল্যাকআউট বিপর্যয় শেষে বিদ্যুৎ সংযোগ পুনঃস্থাপিত হওয়ার পরেও বুধবার ঘন ঘন বিদ্যুৎ লোডশেডিংয়ের ভোগান্তিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছেন ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহের গ্রাহকরা।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)-র তদন্ত কমিটি জাতীয় পাওয়ার গ্রিড বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানে গতকাল বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ উৎপাদন ইউনিট পরিদর্শন করে।
কমিটির সদস্যরা বিপর্যয়ের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি, তবে বিদ্যুৎ বিভাগ এবং পিজিসিবি-র কয়েকজন কর্মকর্তা জানান আশুগঞ্জে একটি গ্রিড লাইন ওভারলোড হওয়ার কথা জানান। অনেকে অনুমান করেছেন ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিটে "ক্যাসকেড ট্রিপিং"-এর কারণে ব্ল্যাকআউটের ঘটনা ঘটে।
সাধারণত বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা ভারসাম্য হারালে ক্যাসকেড ট্রিপিং হয়ে থাকে। উৎপাদনের চেয়ে যখন চাহিদা বেশি থাকে তখন জেনারেটরগুলোর ফ্রিকোয়েন্সি কমে। ফ্রিকোয়েন্সি সংখ্যা একটি নির্দিষ্ট সীমার নিচে নেমে গেলে পুরো গ্রিড ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। ফলে হঠাৎ করেই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়। উৎপাদনের চেয়ে যদি চাহিদা কম হয়, সেক্ষেত্রেও ব্ল্যাকআউট বা গ্রিড বিপর্যয় ঘটতে পারে।
এর আগে গত ৬ সেপ্টেম্বর দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল প্রায় একই ধরনের ঘটনায় তিন ঘণ্টার মতো বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল।
বিদ্যুৎ বিভাগের বিভিন্ন নীতিমালা গঠন সংক্রান্ত ইউনিট পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, কিছু বিচ্ছিন্ন জায়গা রয়েছে যেখানে সঞ্চালন ব্যবস্থা আরও উন্ন করা দরকার।
'এর বাইরে সারা দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য পর্যাপ্ত সক্ষমতা বিশিষ্ট সঞ্চালন ব্যবস্থা রয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'সাম্প্রতিক সময় অবধি আমাদের লক্ষ্য ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শতভাগ বিদ্যুতায়নের ব্যবস্থা করা। তবে বর্তমানে আমরা সঞ্চালন ও বিতরণ খাতকে শক্তিশালী করার জন্য কাজ করছি।'
পিজিসিবির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জামাল উল্লাহ জামাল বলেন, 'বিভিন্ন কারণে গ্রিড বিপর্যয় ঘটতে পারে – যেমন পাওয়ার স্টেশনে গণ্ডগোল, গ্রিড সাব-স্টেশনে ত্রুটি কিংবা বিতরণ ব্যবস্থার যেকোনো পর্যায়ে প্রযুক্তিগত ত্রুটি হওয়া'।
'বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন এবং নিয়মিত আপগ্রেডকরণ এ ধরনের বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে।'
পিজিসিবির সূত্র জানায়, গত ১৩ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাপকহারে বেড়েছে, কিন্তু সঞ্চালন খাতে যথাযথ মনোযোগ দেওয়া হয়নি।
ডিজিটালাইজেশনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জনের পর বাংলাদেশ এখন ২০৪১ সালের মধ্যে একটি স্মার্ট দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্য নিয়েছে, তবে সঞ্চালন খাত এখনও ডিজিটালাইজ করা হয়নি।
পিজিসিবি যেভাবে সঞ্চালন ব্যবস্থা পরিচালনা করে
পিজিসিবি ৫০ মেগাহার্জ ফ্রিকোয়েন্সিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে যা গ্রিডের স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।
যদি ফ্রিকোয়েন্সি ৪৮ মেগাহার্জের নিচে বা ৫২ মেগাহার্জের উপরে চলে যায় তাহলে তখন গ্রিড ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং চাহিদার মধ্যে সমন্বয়ের সঙ্গে এটি ওঠানামা করে।
উৎপাদনের তুলনায় চাহিদা কম থাকলে ন্যাশনাল গ্রিড লাইনের ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে যায়। অন্যদিকে চাহিদা বাড়লে ফ্রিকোয়েন্সি কমে বলে জানান কর্মকর্তারা যখন।
আধুনিক ব্যবস্থাপনায় ফ্রিকোয়েন্সি বাড়লে বিদ্যুৎ উৎপাদন ইউনিটগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে উৎপাদন বন্ধ করে দেয় এবং ফ্রিকোয়েন্সি কমে গেলে ইউনিটগুলো আবার উৎপাদন শুরু করে।
কিন্তু পিজিসিবি এখনও চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে টেলিফোন কলের ওপর নির্ভর করে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু ও বন্ধ করে বলে জানান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর মোহাম্মদ তামিম।
স্মার্ট গ্রিড স্থাপন কি ব্যয়বহুল ও দুঃসাধ্য?
গত ১৪ বছরে বিদ্যুৎ খাতে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে যার ফলে ২০০৯ সাল থেকে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে ২২ হাজার ৫১২ মেগাওয়াটে বৃদ্ধি করেছে।
কিন্তু অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত বিশেষজ্ঞরা বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও অটোমেশন, স্মার্ট গ্রিড এবং সুপারভাইজরি কন্ট্রোল অ্যান্ড ডেটা অ্যাকুইজিশন (এসসিএডিএ) ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়িত হয়নি।
ড. মোহাম্মদ তামিম বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগের আগ্রহের অভাব ছাড়া সিস্টেমটিকে আধুনিক ও ডিজিটাল করার ক্ষেত্রে অন্য কোনো বাধা নেই। অথচ তারা শুধু উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে মনোযোগী।
আধুনিক গ্রিড নিয়ন্ত্রণের নকশা ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান এনকেসফট কর্পোরেশন বর্তমানে দুটি পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সঙ্গে কাজ করছে।
এনকেসফট কর্পোরেশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক জন সাখাওয়াত চৌধুরী বলেন, 'স্মার্ট গ্রিড স্থাপন বড় ব্যাপার নয়। এটি সর্বোচ্চ দুই বছরে করা যেতে পারে এবং এর জন্য প্রায় ২০০ মিলিয়ন খরচ হতে পারে।'
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, স্মার্ট গ্রিড স্থাপনের পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সঞ্চালন ব্যবস্থাকে স্মার্ট ও আধুনিক করার সর্বোত্তম উপায় খুঁজে বের করতে আমরা ইতোমধ্যে একজন পরামর্শক নিয়োগ করেছি।