মুঠোফোনে নির্বিঘ্নে কথা বলায় বাধা হয়ে উঠেছে টাওয়ার সমস্যা
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের থেকে অনুমতি পাওয়ার প্রক্রিয়ায় দেরি হওয়া, স্থাপনযোগ্য সাইটের অভাব এবং সেলফোন টাওয়ার বিকিরণের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা— দেশের টেলিকম অপারেটরদের রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নতুন মোবাইল টাওয়ার স্থাপনের চেষ্টাকে ব্যাহত করছে। যার প্রকৃত ভুক্তভোগী হচ্ছেন মুঠোফোন ব্যবহারকারীরা।
দেশে মুঠোফোন ব্যবহারকারীরা এখন প্রতিনিয়ত দুর্বল নেটওয়ার্ক সিগন্যাল, সংযোগে বিলম্ব এবং কল ড্রপের অভিযোগ করছেন– যা অস্বীকার করেছেন না পরিষেবা প্রদানকারীরাও।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রাহকদের প্রত্যাশা অনুযায়ী মানের সেবা দিতে মোবাইল অপারেটরদের রাজধানীর বিভিন্ন স্পটে অতিরিক্ত ৫০০ টাওয়ার (বেস ট্রান্সসিভার স্টেশন) স্থাপন করা দরকার।
সরকার ২০১৮ সালে টাওয়ারকো (টাওয়ার কো-লোকেশন) নামে পরিচিত চারটি টাওয়ার শেয়ারিং কোম্পানিকে এই দায়িত্ব দেওয়ায়– মোবাইল অপারেটররা এখন নিজেরা টাওয়ার তৈরি করতে পারছে না। কারণ, টাওয়ার কোম্পানিগুলো সেবা ফির বিনিময়ে টাওয়ার নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের সাথে সেগুলি শেয়ার করার অধিকার পেয়েছে।
ফলে যখনই কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় কোনো মোবাইল অপারেটর তাদের সেবার বিস্তার করতে চায়, তখন তাদের নতুন টাওয়ার স্থাপনের জন্য এসব টাওয়ার কোম্পানির শরণাপন্ন হতে হয়। টাওয়ার শেয়ারিং কোম্পানিগুলো তখন নির্দিষ্ট জমির ন্যায্য মালিককে খুঁজে বের করে- তার সাথে ইজারা চুক্তি সই করে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের থেকেও দরকারি অনুমতি নেয়।
এদিকে টাওয়ার অপারেটররাও বলছেন যে, পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ করা খুবই চ্যালেঞ্জিং ও সময়সাপেক্ষ হয়ে উঠেছে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে দেওয়া সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে দেশের বৃহত্তম টাওয়ার কোম্পানি– ইডটকো বাংলাদেশ কোং লিমিটেড-এর কান্ট্রি ম্যানেজিং ডিরেক্টর রিকি স্টেইন বলেছেন, ঘনবসতিপূর্ণ শহরাঞ্চলে লোকেশন ঠিক করা এবং তারপর জমির পূর্ব মালিকানা হাতবদলের কারণে– নতুন সাইটের ইজারা চুক্তি সইয়ের জন্য বৈধ মালিক খুঁজে বের করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
এছাড়াও, নির্বাচিত কিছু জায়গার মালিকানা সরকার বা অন্য প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হওয়ায়– এই প্রক্রিয়া আরও জটিল হয়ে ওঠে বলে জানান তিনি।
দেশের অন্য কয়েকটি টাওয়ার কোম্পানি হলো– সামিট টাওয়ারস লিমিটেড, কীর্তনখোলা টাওয়ার বাংলাদেশ লি. এবং এবি হাইটেক কনসোর্টিয়াম লিমিটেড।
নাম না প্রকাশের শর্তে সামিট টাওয়ারস লিমিটেডের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, টাওয়ার স্থাপনে সিটি কর্পোরেশন এবং বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি)সহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন পেতে দেরি হয়। বিশেষ করে, আন্তর্জাতিক সীমান্ত এলাকায় টাওয়ার স্থাপনের জন্য এখনও প্রায় তিন মাস সময় লাগে, যা আগে ছয় মাস লাগত।
তিনি আরও বলেন, ঢাকা ও অন্যান্য মেট্রোপলিটন এলাকায় মোবাইল টাওয়ারের রেডিয়েশন সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণা এবং জমির মালিকদের ছাদের জন্য উচ্চ ভাড়া নেওয়া– নতুন টাওয়ার স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা।
তবে বিটিআরসির ভাইস-চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র টিবিএসকে বলেছেন, মোবাইল অপারেটররা একবার আবেদন করলে তারা অনুমতি দিতে দেরি করেন না।
তিনি বলেন, 'মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ার স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সূচি রয়েছে। বিটিআরসি এর অতিরিক্ত সময় নেয় না'।
অন্যান্য বিষয়ের কারণে বেস ট্রান্সসিভার স্টেশন স্থাপনে দেরির মতো সমস্যা হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই শিল্পে মোবাইল অপারেটর এবং টাওয়ার কোম্পানির মধ্যে লেভেল-প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে তাদের উভয়কেই সিগনিফিকেন্ট মার্কেট পাওয়ার (এসএমপি) ঘোষণা করা হয়েছে, যাতে অন্যান্য প্রতিযোগিরাও ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ পায়।
মোবাইল অপারেটরদের শুধু ঢাকাতেই আরও ৫০০ টাওয়ার প্রয়োজন
শিল্পের অভ্যন্তরীণরা বলছেন যে, মোবাইল নেটওয়ার্কের গুণমান মূলত স্পেকট্রাম বা ফ্রিকোয়েন্সি এবং নেটওয়ার্ক টাওয়ারের সংখ্যার উপর নির্ভর করে।
ব্যবহারকারীদের উচ্চ ঘনত্বের কারণে, মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের রেডিও স্পেকট্রাম সবসময়ই ছিল অপর্যাপ্ত। তবে গত মার্চে তারা অতিরিক্ত স্পেকট্রাম সংগ্রহ করায় সম্প্রতি এটি কিছুটা উন্নত হয়েছে। প্রতি মেগাহার্জ স্পেকট্রামে এখন ব্যবহারকারীর চাপ (বা অক্যুপেন্সি) এখন কমে গেছে বলে জানা গেছে।
কোনো এলাকার নির্দিষ্ট সংখ্যক ব্যবহারকারীকে একটি টাওয়ারের মাধ্যমে সেবাদান করা হয়, আর এই টাওয়ার প্রতি ব্যবহারকারীর অক্যুপেন্সি এখনও অপারেটরদের জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে। কারণ তারা সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে দরকারি সহায়তা পাচ্ছেন না।
বর্তমানে দেশের বৃহত্তম মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোনের ঢাকা শহরে ১,৭১১টি নেটওয়ার্ক সাইট রয়েছে। তারপরও সম্ভাব্য সর্বোত্তম পরিষেবা দেওয়ার জন্য অপারেটরটির রাজধানীতে আরও ৩৩৪টি নতুন সাইট প্রয়োজন।
এর মধ্যে ৭৫টি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের মধ্যে রয়েছে– সরকারি কৌশলগত এলাকা, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, সিটি কর্পোরেশন এলাকা ইত্যাদি। এসব স্থানে গ্রাহকরা বিশেষ করে দুর্বল নেটওয়ার্ক সিগন্যালের ভুক্তভোগী হচ্ছে।
তবে গ্রামীণফোনের সূত্রগুলি জানায়, সরকারি কর্তৃপক্ষের বিলম্বিত প্রতিক্রিয়া, ভবন মালিকদের অনাগ্রহ এবং টাওয়ার রেডিয়েশনের ভয় ইত্যাদি কারণে টেলিকম অপারেটরদের অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
একইভাবে, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুঠোফোন নেটওয়ার্ক সেবাদাতা রবি আজিয়াটা লিমিটেডেরও ঢাকা অঞ্চলে প্রয়োজনীয় ১১১টি টাওয়ার সাইট নেই।
শিল্পের অভ্যন্তরীণরা জানান, মানসম্পন্ন মোবাইল যোগাযোগ পরিষেবা দেওয়ার জন্য ঢাকায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক নেটওয়ার্ক টাওয়ার নেই বাংলালিংক এবং টেলিটকেরও।
গ্রামীণফোনের এক্সটার্নাল কমিউনিকেশনের প্রধান মো. হাসান টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের প্রতিশ্রুতি এবং সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও– আমরা জটিল লাইসেন্সিং ইকোসিস্টেম এবং বাহ্যিক অন্যান্য কারণে নির্দিষ্ট নেটওয়ার্ক পরিষেবা পেতে গ্রাহকদের সমস্যার বিষয়টি স্বীকার করি। তবে আমরা ফাইবার এবং টাওয়ারের জন্য অন্যান্য পরিষেবা প্রদানকারীর উপর নির্ভরশীল'।
কাভারেজ ঘাটতি এবং অনেক জায়গায় শূন্যস্থান মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে অনেক সময় টাওয়ার কোম্পানিগুলি মোবাইল অপারেটরের পছন্দসই স্থানে টাওয়ার স্থাপন করে দিতে পারে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
'আমরা প্রায় ১০০টি সরকারি স্থাপনা চিহ্নিত করেছি যেখানে টাওয়ার প্রয়োজন, কিন্তু টাওয়ার কোম্পানিগুলি অনুমতি পাচ্ছে না'।
টাওয়ারের বিকিরণ সম্পর্কে ভুল ধারণা এবং সেকারণে বিভিন্নভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকির ভয়ও তাদের নতুন টাওয়ার পাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকক্ষেত্রে পুরানো টাওয়ারগুলিও তারা ভেঙে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন বলে যোগ করেন তিনি।
একইরকম অভিজ্ঞতা তুলে ধরে রবি আজিয়াটা লিমিটেডের প্রধান বাণিজ্যিক এবং নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা শাহেদ আলম বলেন, প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে সরকারি নীতি অমান্য করে– কিছু অপারেটরও তাদের টাওয়ার অবকাঠামো ভাগাভাগি করে নিতে চায় না, যার ফলে খরচ বেড়ে যায়।
বিদ্যমান টাওয়ারগুলি অপারেটরদের মধ্যে ভাগ করে নিলে নেটওয়ার্ক সেবার মান উন্নত হবে বলেও জানান তিনি।
তিনি উল্লেখ করেন যে, সরকারি গাইডলাইন অনুসারে টাওয়ার শেয়ারিং বাধ্যতামূলক। এই বিষয়ে বিটিআরসি-র কঠোর নজরদারি জরুরিভাবে প্রয়োজন বলে মনে করেন শাহেদ আলম।
সেলফোন টাওয়ার কী ক্ষতিকর বিকিরণ ছড়ায়?
মানুষের মধ্যে ব্যাপক ভুল ধারণা রয়েছে যে, টাওয়ার রেডিয়েশন পুরুষের মধ্যে বন্ধ্যাত্ব, শিশুর জন্মগত ত্রুটি এবং ক্যান্সারের কারণ হয়। যদিও এর পেছনে শক্তিশালী কোনো মেডিকেল বা বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।
আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি দাবি করেছে, সেলফোন টাওয়ার নির্গত রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির সংস্পর্শে আসার ফলে জনস্বাস্থ্য লক্ষণীয়ভাবে প্রভাবিত হয়েছে– এসংক্রান্ত কোনও শক্তিশালী প্রমাণ তাদের কাছে নেই।
তবে তারা এও বলেছে যে, তার মানেই এই নয় যে- সেলফোন টাওয়ারের রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি তরঙ্গ একেবারে নিরাপদ বলে প্রমাণিত হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরমাণু প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ শফিকুল ইসলাম অবশ্য সাম্প্রতিক এক সমীক্ষার প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, দেশের কিছু জায়গায় তার গবেষক দল ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে উচ্চমাত্রায় রেডিয়েশন শনাক্ত করেছে।
তিনি বলেন, 'রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিকে একটি নন-আয়নাইজড বিকিরণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়, এটি নীরব ঘাতক হিসেবেও পরিচিত। গবেষণায় আমরা দেখেছি যে, এই বিকিরণের কিছু প্যারামিটার বা স্থিতিমাপক রয়েছে। ক্রমাগত এই বিকিরণের সংস্পর্শে থাকলে মানবদেহের ক্ষতি হতে পারে'।
এই সমীক্ষা গবেষণার আওতায়, মো. শফিকুল আলম সারাদেশে বেস ট্রান্সসিভার স্টেশনের ৩৬১টি অবস্থানের রেডিয়েশনের মাত্রা পরিমাপ করেন।
বিটিআরসিকে নিয়মিত রেডিয়েশন পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
২০১৯ সালে, বিটিআরসি ঢাকা এবং জামালপুরের মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ার থেকে নির্গত তড়িৎচুম্বকীয় রেডিয়েশনের উপর পৃথক একটি পরীক্ষানিরীক্ষা চালায়।
এসব এলাকায় তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রের (ইলেক্ট্রো- ম্যাগনেটিক ফিল্ড বা ইএমএফ) বিকিরণ ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন নন-আয়নাইজিং রেডিয়েশন প্রোটেকশন (আইসিএনআইআরপি) সংস্থার নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়েও অনেক নিম্ন মাত্রার বলে উঠে আসে নিয়ন্ত্রক কমিশনটির অনুসন্ধানে।
বিটিআরসি দেখেছে যে, একটি টাওয়ারের পাঁচ মিটারের মধ্যে ইএমএফ ভ্যালু আইসিএনআইআরপি নির্ধারিত মানদণ্ড অনুসারে ২.৮৭১ ডব্লিউ/এম হওয়ার কথা থাকলেও– তা রয়েছে ০.১০৬১ ডব্লিউ/এম। জামালপুর সদর উপজেলায় এর পরিমাপ পাওয়া যায় ০.০২৬৮ ডব্লিউ/এম।
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কমিশনের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাও নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, মোবাইল সিগন্যালের জন্য ব্যবহৃত রেডিও তরঙ্গে তারা কোনো ক্ষতি দেখছেন না।