গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচন: পরিস্থিতি যেভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল
বিরোধী পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়া, জোর করে ভোট দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগের প্রমাণ পেয়ে আজ গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের নির্বাচন বন্ধ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।
তিন লাখ ৩৯ হাজারের বেশি ভোটারের এই আসনে আজ সকাল আটটা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। এবারই প্রথম ইলেকট্রোনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে এ আসনটিতে ভোট নেওয়া হয়।
সকাল ১০ টার পর কেন্দ্রগুলো থেকে অনিয়মের খবর আসতে থাকে।
এর পর থেকে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা নৌকায় ভোট নেওয়া শুরু করেন। অভিযোগ ওঠে, নৌকার ভোট দিতে অস্বীকার করলে কেন্দ্র থেকে ভোটারদের বের করে দেওয়া হয়।
ঢাকার নির্বাচন ভবনের পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের সিসি ক্যামেরায় ভোটের মাঠে অনিয়মের চিত্র দেখে নির্বাচন বন্ধ ঘোষণা করে কমিশন।
ইভিএমে ভোটারের পরিচয় শনাক্ত হওয়ার পর গোপন কক্ষে অবস্থান নেওয়া ব্যক্তি নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে দেওয়ার অভিযোগ আসতে থাকে।
নির্বাচন কমিশন এই ব্যক্তিদের 'ডাকাত' হিসেবে উল্লেখ করে বলেছে, 'এই ডাকাত ঠেকানোই তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ'।
নির্বাচন চলাকালীন যমুনা নদীর চরাঞ্চলের অনেক কেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়।
এরপর ইসির সিদ্ধান্তে ক্রমাগতভাবে ৫১ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। পরে পুরো নির্বাচন বন্ধ করে কমিশন।
ঢাকার নির্বাচন ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ভোট গ্রহণ বন্ধ ঘোষণা করেন।
এর আগেই বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে অনিয়মের অভিযোগ তুলে ভোট বর্জন করেন আওয়ামী লীগ বাদে অন্য চার প্রার্থী। তারা হলেন, জাতীয় পার্টি থেকে এইচ এম গোলাম শহীদ রঞ্জু (লাঙল), বিকল্পধারার প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম (কুলা), স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদুজ্জামান নিশাদ ও মাহবুবুর রহমান। অবিলম্বে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে এ আসনে আবারও নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানান তারা।
তাদের অভিযোগ আওয়ামী লীগ সমর্থিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মাহমুদ হাসান রিপনের অনুসারীরা 'সন্ত্রাসী কায়দায়' 'ভোট ডাকাতি' করছে, সেখানে প্রশাসনের লোকজনও সহয়তা করেছেন।
নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলগুলোর প্রার্থীরা অভিযোগ করেন, প্রশাসনের সহযোগিতায় সব কয়টি গোপন কক্ষে নৌকা মার্কায় জোর করে সুইচ টিপে ভোট নিচ্ছে আওয়ামী লীগের কর্মীরা। ভোটারদের এমপি পদে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে দেয়া হয়নি। সব কেন্দ্রের সব প্রতীকের নির্বাচনী এজেন্টকে মারধর করে বের করে দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর সময় দেওয়া বক্তব্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদুজ্জামান নিশাদ বলেন, 'আমি নিজের ভোট নিজেই দিতে পারি নি। ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার পর সকালে আমার এলাকার দহিচরণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে গেলে আমাকে নৌকা প্রতীকের লোকজন বাধা দেয়। এ সময় আমার লোকজনকে মারধর করে রক্তাক্ত করা হয়েছে। অথচ তারাই এখন আমার কর্মী-সমর্থকদের হয়রানিমূলক মামলা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।'
লাঙল প্রতীকের প্রার্থী এইচ এম গোলাম শহীদ রঞ্জু বলেন, 'এটা আসলে নির্বাচনের নামে প্রহসন। ইতিমধ্যে অনেক কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। ইলেকশন কমিশন বলেছে নির্বাচন পরিস্থিতি কন্ট্রোলে নেই। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে এ নির্বাচন কেমন হচ্ছে। এটা কোনো নির্বাচনই না। আমি নির্বাচন বর্জন করলাম।'
একই স্থানে দাঁড়িয়ে বিকল্প ধারার প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'প্রতিটি কেন্দ্রই নৌকা প্রতীকের লোকজনের দখলে। আমাদের কর্মী-সমর্থক ভোট দিতে পারছে না। আমাদের ওপর হামলা হচ্ছে। এই ভোট মেনে নেওয়া যায় না। আমি ভোট বর্জনের ঘোষণা দিচ্ছি। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটের আয়োজন করে নতুন করে তারিখ ঘোষণার। আমরা তখন নির্বাচনে অংশ নিব।'
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সব কেন্দ্রেই শুধু নৌকা প্রতীকের এজেন্ট রয়েছে। অন্য প্রার্থীদের এজেন্টেদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।
'প্রতিটি কেন্দ্র থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যারা নৌকায় ভোট দিবে তারা শুধু কেন্দ্র আসবে। এছাড়া অন্য কেউ আসেত পারবে না। কেন্দ্রে অনেকে ভোট দিতে গেলে তাদেরকে বলা হয় নৌকা ছাড়া অন্য কোনো প্রতীকে ভোট দেওয়া যাবে না। ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। ভয় পেয়ে ভোটাররা কেন্দ্রে আসতে চাচ্ছেন না।
উপনির্বাচন 'নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে' বলার কয়েক ঘণ্টা পর বন্ধ ঘোষণা দিয়ে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, 'সবাই দেখতে পাচ্ছি যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। আপনারাই দেখতে পাচ্ছেন যে গোপন কক্ষের ভেতরে- বাইরে লোকজন যাওয়া আসা করছে।
'কেন এমনটি ঘটলো তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যাবে না।
'এখন আর ভোট হচ্ছে না। পরবর্তীতে বিধি বিধান অনুযায়ী কী করতে হবে দেখব। কমিশন বসে সিদ্ধান্ত নেব।'