স্থানীয় গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ৪ গুণ বেড়েছে
গত ১৩ বছরে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় চারগুণ বেড়ে ২.৫০ টাকা থেকে হয়েছে ১০ টাকা। বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস-ভিত্তিক উৎপাদনের অংশ ক্রমাগত কমতে থাকায় এবং সে তুলনায়, আমদানিকৃত তরল জ্বালানির ব্যবহার বাড়ায় হয়েছে এই হাল।
গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুতের চেয়ে আমদানি করা জ্বালানি তেলে উৎপাদনের খরচ অনেক বেশি। বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের চলমান অস্থিতিশীলতায় যা বর্তমানে নাটকীয় উচ্চতায় পৌঁছেছে। যার ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ সংস্থার বিপুল অর্থ খরচ হচ্ছে।
পাঁচ মাস ধরে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকের বিল মেটাতে পারেনি সংস্থাটি। উৎপাদকদের পাওনার পরিমাণ ১৬ হাজার কোটি টাকা।
যতটা ধারণা করা হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি কমেছে দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলি থেকে পাওয়া সরবরাহ। ফলে সংস্থাটিকে আরও বেশি করে ব্যয়বহুল জ্বালানি তেল আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। এতে উৎপাদন খরচও আরো বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড- পিডিবির সদস্য (অর্থায়ন) এস কে আক্তার হোসেন বলেন, 'আমরা যদি চাহিদার তুলনায় ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কম পাই, এবং সে চাহিদা যদি তেল-ভিত্তিক বিদ্যুতের মাধ্যমে পূরণ করতে হয় তাহলে উৎপাদন ব্যয় বছরে ৫ হাজার কোটি টাকা বেড়ে যায়। গত বছরের তুলনায়, আমরা এখন ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট কম গ্যাস সরবরাহ পাচ্ছি'।
গত কয়েক মাসে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলিতে দৈনিক গ্যাস সরবরাহ ১১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট থেকে ৯৫০ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে এসেছে।
গত বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) দেশের বিভিন্ন খাতে প্রতিদিন ৩,১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করত; যা এখন ২,৬৭০ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে এসেছে।
মিশ্র-জ্বালানি নীতি অনুসরণ
স্থানীয় গ্যাস ক্ষেত্রগুলি থেকে সরবরাহ কমতে থাকার মধ্যেই সরকার নিজস্ব মিশ্র-জ্বালানি পরিকল্পনার অংশ হিসাবে ধীরে ধীরে তরল জ্বালানি-ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রসারিত করেছে।
কিন্তু, বিশ্ববাজারে জ্বালানি-তেল, গ্যাস ও কয়লার দামে অস্থিরতা; তেল-ভিত্তিক প্ল্যান্টর বিদ্যুৎ উৎপাদনকে অত্যন্ত ব্যয়বহুল করে তুলেছে। ফলে ব্যয়ের ভারী বোঝা বহন করতে হচ্ছে বিদ্যুৎ বোর্ডকে।
এস কে আক্তার হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন গ্যাসভিত্তিক উৎপাদনের চেয়ে ১০-১২ গুণ বেশি ব্যয়বহুল।
'বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস ব্যবহারই সস্তা উপায়। কিন্তু, গ্যাস-ভিত্তিক কেন্দ্রগুলিকে পূর্ণ সক্ষমতায় চালানোর মতো পর্যাপ্ত গ্যাস না পাওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে আমাদের চড়া খরচে তেল-ভিত্তিক প্ল্যান্টেই উৎপাদন করতে হবে।
স্থানীয় গ্যাস ক্ষেত্রে উৎপাদন কমতে থাকাকালেই সরকার ২০১৮ সালে এবং ২০২০ সালে স্পট মার্কেট (খোলা বাজার) থেকে একটি দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির অধীনে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি শুরু করে।
কিন্তু, বিশ্ববাজারে দামের অস্থিরতার কারণে সরকার খোলাবাজার থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ করায় সরবরাহের এই উৎসটিও দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেন, দেশের বৃহত্তর কল্যাণের কথা চিন্তা করেই তারা অতি উচ্চমূল্যের খোলা বাজার থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ করেছেন।
পেট্রোবাংলা এই বাজার থেকে প্রতি মেট্রিক মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (এমএমবিটিইউ) এলএনজি আমদানি করত ৬-৭ সাত ডলার দরে, যা এখন ৩৯ ডলারের কাছাকাছি রয়েছে।
নাজমুল আহসান বলেন, 'এর বদলে আমরা ওয়ার্কওভার, গভীর কূপ খনন এবং রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি'।
ব্যয়বহুল তরল জ্বালানি সস্তা গ্যাসকে প্রতিস্থাপন করছে
২০০৯ সালে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড গ্যাস-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৮৮.৪৪% বিদ্যুৎ উৎপাদন করত। ওই সময়ে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৫,৪৯৩ মেগাওয়াট।
মোট শক্তির মিশ্রণে ফার্নেস অয়েল এবং ডিজেল-ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের অংশ ছিল যথাক্রমে ৩.৮৯ ও ২.০৩ শতাংশ।
গ্যাস-ভিত্তিক প্ল্যান্টের সক্ষমতাও গত ১৩ বছরে বেড়েছে; এই সময়ের মধ্যে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা। এরমধ্যে মাত্র ৫৬.৪৩ শতাংশ করছে গ্যাস-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র।
রবিবার পর্যন্ত, সন্ধ্যার পিক আওয়ারে বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ১২,৩০৯ মেগাওয়াট।
স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে সরবরাহ ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকায় সরকার ঘাটতি মেটাতে এবং সারা দেশে বিদ্যুৎ সংযোগের আওতা বাড়াতে সরকারি ও বেসরকারি অর্থায়নে কয়েক ডজন তেল-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের মার্চের প্রতিবেদন অনুসারে, মোট বিদ্যুতের ২৬.৪০% যোগান দিচ্ছে ফার্নেস অয়েল-ভিত্তিক উৎপাদন। আর মোট শক্তির মিশ্রণে ডিজেল-চালিত কেন্দ্রগুলির অবদান ০.৯২ শতাংশ।
২০০৮-২০০৯ সালে, বিভিন্ন জ্বালানি মিশ্রণ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের গড় খরচ ছিল প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টায় আড়াই টাকা। কিন্তু, এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের গড় খরচ ১০ টাকা কিলোওয়াট ঘণ্টায় পৌঁছেছে।
ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক প্ল্যান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউনিটপ্রতি খরচ হয় ১৭ টাকা; ডিজেল ভিত্তিক প্ল্যান্টে যা ৩৭ টাকা এবং গ্যাসভিত্তিক প্ল্যান্টে এই মূল্য ৩ থেকে ৩.৫ টাকা।
কিন্তু, কম মূল্যের গ্যাস সরবরাহ হ্রাস পেতে থাকায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে আরও ব্যয়বহুল বিকল্প নিতে হচ্ছে—যা একে সরকারের একটি দীর্ঘস্থায়ী লোকসানি প্রতিষ্ঠান করে তুলছে।
২০০৯ সাল থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয় এবং ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি করার ফলে বিদ্যুৎ সংস্থাটির পুঞ্জীভূত লোকসান ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
পিডিবি যেভাবে বেসরকারি উৎপাদকদের পাওনা পরিশোধ করতে পারে
দেশের বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের তথ্য অনুযায়ী, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড তাদের থেকে গত এপ্রিল মাসে কেনা বিদ্যুতের বিল এখনও পরিশোধ করেনি।
বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের কাছে ১৬ হাজার কোটি টাকা—যা পাঁচ মাসের বিদ্যুৎ বিলের সমতুল্য—বকেয়া থাকায় বিদ্যুৎ সংস্থাটির আর্থিক পরিস্থিতিও অনিশ্চিত।
এসকে আক্তার হোসেন বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের সরবরাহ কম থাকা, তেলের দাম বৃদ্ধি এবং ডলারের চড়ামূল্যই বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী।
জমে থাকা বকেয়া কীভাবে পরিশোধ করা হবে—সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পিডিবির ক্রয়মূল্য এবং বিদ্যুতের পাইকারি বিক্রয়মূল্য সমন্বয় হতে পারে সমাধানের একটি উপায়।
বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদকদের থেকে পিডিবি যে দামে বিদ্যুৎ কিনছে তার সাথে বিতরণকারী কোম্পানির কাছে সংস্থাটির পাইকারি বিক্রয়মূল্যের ৫ টাকা ব্যবধান রয়েছে।
সমাধানের দ্বিতীয় উপায় হিসেবে, বিদ্যুতের ওপর আরোপিত বিভিন্ন কর যৌক্তিককরণের কথা বলেন পিডিবি'র এ বোর্ড সদস্য।
বর্তমানে বিদ্যুতের ওপর ৪০ শতাংশের বেশি ভ্যাট ও কর আরোপিত রয়েছে, যা শক্তি উৎপাদনকে আরও ব্যয়বহুল করে তুলছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন, ক্রয় ও খুচরা পর্যায়ে একই কর বারবার আরোপ করা হয়েছে; যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সূত্রগুলি।
বিদ্যুৎ বিভাগ এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে বিদ্যুতের ওপর কর পুনর্বিন্যাসের আবেদন করেছিল। কিন্তু এনবিআর এ আপিল খারিজ করে দিয়েছে বলে সূত্রগুলি জানিয়েছে।