ঝুঁকিপূর্ণ নড়িয়া সেতুর কারণে পদ্মা সেতুর সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছে হাজারও মানুষ
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ভাষাসৈনিক ডাঃ গোলাম মাওলা সেতুটি গত ৭ বছর ধরে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। ভারী যানবাহনগুলো ১৫ কিলোমিটার পথ ঘুরে শরীয়তপুর সদর উপজেলা হয়ে চলাচল করছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছে কয়েক লাখ মানুষ। পদ্মা সেতু চালু হলেও পুরোপুরি সুফল পাচ্ছে না এ অঞ্চলের মানুষ। ভেঙে পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। বছরের পর বছর ধরে পুরোনো সেতুর পাশ দিয়েই চলছে নতুন সেতু নির্মাণ কাজ। কিন্তু নেই কাঙ্খিত অগ্রগতি। এতে ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা। তবে এলজিইডি'র দাবি নির্দিষ্ট সময়েই শেষ হবে সেতুর নির্মাণ কাজ।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সূত্র জানায়, ঢাকার সাথে সড়কপথে যোগাযোগ সহজ করতে ১৯৯৭- ৯৮ অর্থবছরে কীর্তিনাশা নদীর ওপর নির্মাণ করা হয় ভাষাসৈনিক ডাঃ গোলাম মাওলা সেতু। কিন্তু মাত্র ১৭ বছরের মাথায় সেতুর পূর্ব প্রান্তের পিলার আর সংযোগ সড়কের মাটি সরে যায়। এরপর ২০১৫ সালে সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। বন্ধ করে দেয়া হয় সব ধরনের যান চলাচল। শুধু পায়ে হেঁটে পারাপারের জন্য মূল সেতুর সাথে বেইলি সেতু স্থাপন করে দেয়া হয়। ঝুঁকি বিবেচনায় সেতুর উভয় প্রান্তে লোহার খুঁটি বসিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করে দেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেই বাধাও সরিয়ে ছোট যানবাহন ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। এতে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। হারাচ্ছে প্রাণ।
জনদুর্ভোগ লাঘবে ঝুঁকিপূর্ণ ওই সেতুর স্থলে নতুন সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় এলজিইডি। প্রথমে ২০১৭ সালে ১৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৪৫ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল। ২০১৯ সালের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কয়েক বার মেয়াদ বৃদ্ধি করেও কাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নাভানা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। ৩০ শতাংশ কাজ করে পালিয়ে যায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এরপর বাতিল করা হয় ওই প্রকল্প।
এরপর দ্বিতীয়বারের মতো আবার ২০২১ সালে পুনরায় ভাষাসৈনিক গোলাম মাওলা উড়াল সেতু নামে নতুন নকশায় সেতু নির্মাণের প্রকল্প নেয় এলজিইডি। যার মেয়াদ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সাল পর্যন্ত। ৩২৭ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতু যার মধ্যে মূল সেতু ১০৫ মিটার এবং ভায়াডাক্ট ২২২ মিটার। ৯ দশমিক ৮ মিটার প্রস্থের এই সেতুর নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ২৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। কিন্তু সেই কাজেও ভাটা পড়েছে। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও নেই কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি। মেয়াদের এক-তৃতীয়াংশ সময় পার হলেও কাজের অগ্রগতি মাত্র ৮ ভাগ। এবারও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্মাণকাজ সম্পন্ন হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
কীর্তিনাশা কোল ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে নড়িয়া বাজার ও উপজেলা শহর। ঢাকাসহ বিভিন্ন বন্দর থেকে ব্যবসায়ীরা পণ্য পরিবহন করতেন এ পথেই। এখন দীর্ঘ পথ ঘুরে পণ্য পরিবহন করতে বাধ্য হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এতে তাদের বেড়েছে সময় ও পরিবহন খরচ। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের তিন মাস পেরিয়ে গেলেও নড়িয়ার ঝুঁকিপূর্ণ এই সেতুর কারণে সুফল পাচ্ছে না নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জের মানুষ। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা যাত্রীবাহী বাস থেমে যাচ্ছে সেতুর পশ্চিমপ্রান্তেই। ফলে উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াত করা মানুষ পড়েছেন দুর্ভোগে। ভেঙে ভেঙে যেতে হচ্ছে গন্তব্যে। এতে লাগছে অতিরিক্ত সময় ও অর্থ।
অপরদিকে সেতুর পশ্চিমপ্রান্তের বসবাসকারী মানুষ নানামুখী সেবা থেকে বঞ্চিত। উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও চিকিৎসা নিতে পারছেন না কয়েক ইউনিয়নের মানুষ। মুমূর্ষু রোগী নিয়ে দীর্ঘ পথ ঘুরে যেতে হচ্ছে অন্যত্র। ভোগান্তি কম নয় শিক্ষার্থীদেরও। ব্যাঘাত ঘটছে নিয়মিত লেখাপড়ায়। এদিকে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য নিয়ে পড়ছেন বিপাকে। দফায় দফায় করতে হচ্ছে গাড়ি পরিবর্তন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত তারাও।
নড়িয়া বাজারের ব্যবসায়ী আলী আকবর বেপারী বলেন, 'নড়িয়া বাজারের যতো মালামাল ঢাকা থেকে আসে, ব্রিজ না থাকার কারণে বিভিন্ন রোডে মালগুলো আনতে হয়। ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার ঘুরে ট্রাকগুলো আসে। এছাড়া দূর-দুরান্ত থেকে যে সব কাস্টমার আসতো তারাও আসতে পারছে না অন্য সব বাজারে চলে যাচ্ছে। এতে কেনাবেচা কমে গেছে আবার মালামাল পরিবহন খরচও বেড়ে গেছে। যার ফলে ব্যবসায় টিকে থাকাই কষ্ট হয়ে গেছে। এমন চলতে থাকলে অচিরেই ব্যবসা গুটিয়ে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।'
পরিবার নিয়ে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি নড়িয়ার শিমুলতলায় যাচ্ছিলেন মোঃ হাফিজ খান। তিনি বলেন, 'যাত্রাবাড়ি থেকে নড়িয়ার গাড়িতে উঠলাম। দ্রুত সময়ের মধ্যেই পদ্মা সেতু পার হয়ে নড়িয়ায় চলে আসলাম। কিন্তু নড়িয়া এই ব্রীজটা দিয়ে বাস চলাচল করতে না পারায় নদীর ওপারে নেমে যেতে হলো। এরপর পায়ে হেঁটে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ওপারে যাচ্ছি। এরপর অন্য কোনো যানবাহনে আবার শিমুলতলায় যেতে হবে। যেমন কষ্ট, তেমনি সময় ও অর্থ অপচয়। পদ্মা সেতু হইলো কিন্তু আমরা নড়িয়াবাসী পুরোপুরি সুবিধা পাচ্ছি না এই ব্রীজের কারণে।'
মোক্তারেরচর ইউনিয়নের কৃষক মোস্তফা বেপারী বলেন, 'এই ব্রীজটার কাজ কতোটুকু করেই চলে যায়। এই ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না। ব্রীজটা হয় না কিসের জন্য? আমরা দুধ নিয়ে বাজারে সময়মতো যেতে পারি না। দাম কম পাই। পাট, ধান যা নিয়ে বাজারে যাই সব ব্রীজের এপারে রেখে মাথায় করে পার করতে হয়।'
চিকিৎসা না পাওয়া একজন ভুক্তভোগী আমিরণ নেছা বলেন, 'উপজেলায় হাসপাতাল আছে। কিন্তু অসুস্থ হলে এই ব্রীজের কারণে গাড়ি যায় না। অনেক ঘুরে সদরে যেতে হয়। অনেক সময় ডেলিভারি রোগী রাস্তায়ই অসুস্থ হয়ে মরে যায়।'
প্রকল্প এলাকায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাউকে পাওয়া যায়নি। নড়িয়া পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবু জাফর শেখ বলেন, 'কিছুটা কাজ করে ঠিকাদারের লোকজন চলে গেছে আবার মাঝে মাঝে আসে। তাই এখন নাই। এর আগেও আরেক ঠিকাদার এমন ঢিলেঢালা কাজ করে চলে গেছে। আমার জনগণের তো কষ্ট হচ্ছে। ৭/৮ বছর ধরে এমন দুর্ভোগ। ঠিকাদারের লোকজনকে জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে তাই একটু ধীরে কাজ করছি। এক বছর পার হয়ে গেলো কিছুই তো দেখছিনা।'
এলজিইডি নড়িয়া উপজেলা প্রকৌশলী মোঃ শাহাবুদ্দিন খান বলেন, 'ঝুঁকিপূর্ণ সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দুটি সাইনবোর্ড সেতুর উভয় প্রান্তে টাঙানো হয়েছিল। একই সাথে সেতুর ওপর দিয়ে যাতে কোনো যানবাহন চলতে না পারে, সেজন্য লোহার এ্যাঙ্গেল দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়েছিল কিন্তু আমাদের অগোচরেই কে বা কারা সেটা তুলে ফেলেছে। তবে শিগগিরই তা পুনঃস্থাপন করা হবে।'
নতুন সেতুর অগ্রগতি নিয়ে তিনি বলেন, 'নতুন প্রকল্পের কাজ চলমান আছে। ইতোমধ্যে একটা স্লাব ঢালাই হয়ে গেছে। আর ভায়াডাক্ট প্রান্তের পাইল কাস্টিংয়ের এ্যারেজমেন্টের কাজ চলছে। নানা কারণেই কাজ কিছুটা ধীর। এ পযর্ন্ত অগ্রগতি ৮ শতাংশ যা সন্তোষজনক নয়। আমরা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে তাগিদ দিচ্ছি।'