সিত্রাং: উপকূলে ভারী বৃষ্টি, বাঁধ ভাঙন আতঙ্ক, মোংলা বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ
ঘূর্ণিঝড় 'সিত্রাং' এর প্রভাবে খুলনায় চলছে ভারি বৃষ্টি। সকাল থেকে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে বাতাসের তীব্রতাও। ফলে দেশের সমুদ্রবন্দরে সতর্ক সংকেত বাড়িয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অফিস। এ পরিস্থিতিতে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
অন্যদিকে, মোংলা বন্দরে পণ্য ওঠা নামার কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের জ্যৈষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মো. আমিরুল আজাদ বলেন, 'পূর্ব-মধ্যে বঙ্গপসাগর ও তৎসংলগ্ন পশ্চিম মধ্য বঙ্গপসাগর এলাকায় একটি ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং অবস্থান করছে। বর্তমানে এটি মোংলা বন্দর থেকে ৫২৫ মিলিমিটার দূরে রয়েছে। এর গতিবেগ রয়েছে ঘন্টা ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত। উপকূলীয় এলাকায় এর প্রভাব শুরু হয়েছে।'
'সকাল থেকে খুলনা ও আশেপাশে জেলায় ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। সকাল ৬ টা থেকে দুপুর ১২ টা পর্যন্ত খুলনায় রেকর্ড করা হয়েছে ৬৫ মিলি মিটার বৃষ্টিপাত। বর্তমানে খুলনাতে ১৫-২০ কিলোমিটার গতিবেগে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে বাতাসের গতিবেগ আরও বাড়বে।'
এদিকে ঘূর্ণিঝড় 'সিত্রাং' এর খবরে আতঙ্কে রয়েছেন খুলনার উপকূলীয় এলাকার মানুষরা। আইলা, সিডর ও আম্পানের পরে আবারও ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এর আঘাতের খবরে জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কায় রীতিমত আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন তারা।
খুলনার কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম শফিকুল ইসলাম বলেন, 'কয়রার হরিণখোলা ও গাতিরঘেরীর বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। স্থানীয়দের নিয়ে মেরামতের কাজের প্রস্তুতি চলছে। এছাড়া কয়রায় হোগলা, দোশহালিয়া, মদিনাবাদ লঞ্চঘাট, ঘাটাখালী, গাববুনিয়ার, আংটিহারা, ৪ নং কয়রা সুতির গেট ও মঠবাড়ির পবনা পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে।'
প্রত্যেক ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের স্ব স্ব এলাকার বাঁধের দিকে খেয়াল রাখার জন্য বলা হয়েছে ও সাইক্লোন শেল্টারগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।
গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম বলেন, 'চারপাশে নদীবেষ্ঠিত গাবুরাকে ঘিরে থাকা বাঁধ আইলার পর থেকে বেশ নিচু হয়ে আছে। এছাড়া ইয়াস ও আম্পানের পর থেকে বড়গাবুরা, হরিশখালীসহ কয়েকটি অংশের বাঁধও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে টেকসই বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও অদ্যাবধি কাজ শুরু হয়নি। এমতাবস্থায় ইউনিয়নের ৪০ হাজারের বেশী মানুষ ঘূর্ণিঝড়ের আশংকায় শংকিত হয়ে পড়েছে।'
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় বেড়িবাঁধ রয়েছে মোট ১ হাজার ৯১০ কিলোমিটার। ষাটের দশকে মাটি দিয়ে তৈরি এই বেড়িবাঁধ ছিল ১৪ ফুট উঁচু ও ১৪ ফুট চওড়া। এখন এই ২৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের উচ্চতা ও চওড়ার অর্ধেকও অবশিষ্ট নেই।
তবে স্থানীয়দের ভাষ্য ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের পরিমাপ আরও বেশি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল) অ্যাডিশনাল চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম তাহমিদুল ইসলাম বলেন, 'দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলোর পানির উচ্চতা স্বাভাবিক চেয়ে ২ থেকে ৩ ফুট বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে কোথাও কোথাও বাঁধ উপচে পানি ঢোকার সম্ভাবনা আছে।'
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের বলেন, 'সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডেও দু'টি বিভাগের আওতায় ৭৮০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। যার মধ্যে ২০০ কিলোমিটারের ৩৫টি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ। ইতিমধ্যে আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো সংস্কার করা হয়েছে। তাছাড়া বাকি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় দুর্যোগ মোকাবিলায় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।'
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-২এর সেকশন অফিসার মাসুদ রানা জানান, 'পাউবো'র প্রধান প্রকৌশলীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রোববার সকাল থেকে শ্যামনগরের ভাঙন কবলিত নেবুবুনিয়াসহ বিভিন্ন এলাকা পরির্দশন করেছেন। পাউবোর পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে সেখানে জিও ব্যাগ স্থাপনসহ জিও শিট বিছানো এবং মাটি দেয়ার কাজ শুরু হয়েছে। সোমবারও ঝুকির্পর্ণ এসব স্থানে কাজ অব্যহত রয়েছে।'
খুলনা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, 'খুলনার দাকোপ উপজেলার ৩২ নম্বর পোল্ডারের কিছু স্থানে সমস্যা রয়েছে। আমরা আপাতত দূর্যোগ মোকাবেলার জন্য সেখানে চেষ্টা করছি।'
অন্যদিকে, ঝড়ের কারণে গাড়িসহ পাঁচটি বাণিজ্যিক জাহাজ মোংলা বন্দরে ঢুকতে পারেনি। এছাড়া পণ্য খালাস শেষ হওয়ার পরও তিনটি জাহাজ বন্দর ত্যাগ করতে পারেনি।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টার ক্যাপ্টেন শাহীন মজিদ বলেন, সাত নম্বর বিপদ সংকেত জারি হওয়ার পর আমরা জরুরি সভা করে বন্দরের নিজস্ব এলার্ট-থ্রি জারি করেছি।
এছাড়া রোবাবার রাত থেকে বন্দরে অবস্থানরত ১৩টি বাণিজ্যিক জাহাজের কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা রাখা হয়েছে। ঝড়ের কারণে সার, কয়লা ও গাড়িসহ পাঁচটি জাহাজ এই বন্দরে ঢুকতে পারেনি। এছাড়া পণ্য খালাস শেষ হওয়ার পরও তিনটি জাহাজ বন্দর ত্যাগ করতে পারেনি।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ূন কবির বলেন, 'ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং মোকাবেলায় ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসন। ইতিমধ্যে উপকূলীয় উপজেলা প্রশাসনকে দুর্যোগ মোকাবিলায় অগ্রিম প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুটি বিভাগের ৭৮০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ৮০ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে ১০ টি পয়েন্টে ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বেড়িবাঁধ ভাঙ্গন এড়াতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে ২০ হাজার জিও ব্যাগ মজুদ রাখা হয়েছে।'
জেলা প্রশাসক আরও জানান, সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলায় ১০৮ টি এবং শ্যামনগর উপজেলায় ১০৩ টি আশ্রয় কেন্দ্রসহ ৪৬ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া দূর্যোগ মোকাবেলায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার, প্রয়োজনীয় ঔষধ, সুপেয় পানিসহ প্রয়োজনীয় সহ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রস্তুত রয়েছে ছয় হাজার স্বেচ্ছাসেবক। এছাড়া দুর্যোগকালীন জরুরী সাড়াদানের জন্য জেলায় খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ।
বাগেরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, 'আমাদের ৩৪৪টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। নির্দেশনা পাওয়া মাত্রই ঝূকিপূর্ণ এলাকার মানুষদের আশ্রয়ন কেন্দ্রে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়া ২৯৮ মেট্রিকটন চাল ও নগদ ৪ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজন দেখা দিলেই সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বিতরণের নির্দেশনা দেওয়া হবে।'
খুলনা জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, প্রাকৃতিক দূর্যোগে প্রাণহানি এড়াতে জেলার ২ লাখ ৭৩ হাজার ৮৫০ জনের জন্য ৪০৯ টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
আশ্রয় কেন্দ্রের মধ্যে দাকোপে ১১৮ টি, বটিয়াঘাটায় ২৭ টি, কয়রায় ১১৭ টি, ডুমুরিয়ায় ২৫ টি, পাইকগাছায় ৩২ টি, তেরখাদায় ২২ টি, রূপসায় ৩৯ টি, ফুলতলায় ১৩ টি ও দিঘলিয়ায় ১৬টি।
খুলনার জেলা প্রশাসক মো. মনিরুজ্জামান তালুকদার বলেন, 'উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বিশেষ কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। যারা ঝুঁকির মধ্যে আছে, তাদের যাতে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া যায়-সেজন্য সবাইকে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আজ সোমবারের মধ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হবে।'
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ২০ মে সুপার সাইক্লোন আম্ফানের আঘাতে খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, সাতক্ষীরার, শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলা এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০০৯ সালের ২৫ মে আম্ফান নামক দূর্যোগে খুলনায় ব্যপক ক্ষতি হয়। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডরে জেলার কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ ও বটিয়াঘাটা উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।