সমতলের চা: সম্ভাবনার শিল্পে শঙ্কার ছাপ
সমতলের চা বাগানের পাতা থেকে কারখানাগুলো ২২৫ কোটি টাকার চা বিক্রি করেছে। সরকার চা বাগানের কল্যাণে গত অর্থবছরে ৩৪ কোটি টাকার রাজস্ব পেয়েছে। এই হিসাবের খাতা থেকে চা বোর্ডও পেয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা। এই অঞ্চলে উৎপাদন আরও বাড়ছে। সরকার, চা বোর্ড ও কারখানা লাভবান হলেও বছরের পর বছর ধরে কৃষকেরা লোকসান গুনছে। এভাবে চলতে থাকলে চা বাগানই এক সময় উত্তরাঞ্চলের কৃষকের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে। তখন কৃষক না বাঁচলে এই চা বাগান দিয়েই কী হবে?
পঞ্চগড় সদরে চা বাগান করে ১৫ বছর ধরে লোকসানের মুখে থাকা কৃষক শাহজালাল আক্ষেপ করে কথাগুলো চা বোর্ডের আঙিনায় দাঁড়িয়ে বললেন। জানালেন, চা বোর্ডের কর্মকর্তাদের কথা শুনে লাভের আশায় থাকতে থাকতে এবার চা বাগান কেটে মসলা ও আমের চাষ শুরু করতে হয়েছে।
যদিও চা বোর্ডের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ভুল প্লাকিং পদ্ধতির কারণে কৃষকেরা চায়ের দাম কম পাচ্ছে। তবে ২১ বছর পার করে চা শিল্প এখন সফলতার দ্বারপ্রান্তে।
চা শিল্পের সফলতার দ্বারপ্রান্তে এসে এমন কথা কেন বলছেন, তার প্রত্যুত্তরে কৃষক শাহজালাল তার বক্তব্যে অনঢ় থেকে জানালেন, 'প্রতিশ্রুতি শুনে নিঃস্ব হওয়ার আগে এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। এখন চা বাগান করে আমরা শুধু কারখানা মালিকদের পুনর্বাসিত করছি। একই সাথে চা উৎপাদন আর রাজস্বের সরকারি হিসাবের খাতায় যুক্ত হচ্ছি।'
সমতলে চা চাষাবাদ শুরু হয় পঞ্চগড় জেলায় ২০০০ সালে। ক্ষুদ্র পর্যায়ে তেঁতুলিয়া টি কোম্পানি এবং পরে কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেটের হাত ধরে বাগান পর্যায়ে চা চাষ শুরু হয়। ২০০৭ সালে ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট এবং ২০১৪ সালে দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলায় চা চাষ শুরু হয় বাগান পর্যায়ে। পাঁচটি জেলায় নিবন্ধিত ৯টি ও অনিবন্ধিত ২১টি বড় চা-বাগান (২৫ একরের ওপরে) রয়েছে। ক্ষুদ্রায়তন চা-বাগান (২৫ একর পর্যন্ত) রয়েছে ৮ হাজার ৬০টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৭৪৫টির নিবন্ধন রয়েছে। পাঁচ জেলায় চা চাষাবাদ হচ্ছে ১১ হাজার ৪৩৩ একর জমিতে। যদিও চা বোর্ডের জরিপে এই অঞ্চলে ৪০ হাজার একর জমিতে চা চাষের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ রয়েছে।
চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক অফিস বলছে, গত বছরে পাঁচ জেলায় ৭ কোটি ৩৫ লাখ ৬৮ হাজার ৯ কোটি চা পাতা উৎপাদন করা হয়েছে। এই পাতা থেকে চা উৎপন্ন হয়েছে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার কোটি কেজি। ২০২১ সালে ১ হাজার ২৬৭ একর জমি বৃদ্ধি (১২.৪২%) পেয়েছে। ৪২ দশমিক ৩০ লাখ কেজি বেশি চা (৪১.০২%) উৎপন্ন হয়েছে। এই উৎপাদনে জাতীয় অবদান ১৫ শতাংশ। আর অঞ্চলভিত্তিক চা উৎপাদনে দ্বিতীয়। অর্থাৎ সিলেটের পর এখন রংপুর অঞ্চলেই বেশি চা উৎপন্ন হয়।
চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সারা দেশে ৯৬ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে শুধু উত্তরাঞ্চলে তৈরি চা (মেড টি) উৎপাদিত হয়েছে ৯৫ লাখ ৯৯ হাজার কেজি।
বাগান থেকে চা পাতা তুলে কারখানায় চা (রেডি টি) তৈরি করা হয়। সমতলের চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা লাইসেন্স নিয়েছে ৪৫টি কারখানা। এর মধ্যে একটি ঠাকুরগাঁওয়ে, অন্যটি লালমনিরহাটে। বাকীগুলো পঞ্চগড়ে। এখন চালু রয়েছে ঠাকুরগাঁওয়ের একটিসহ ২৫টি কারখানা। এসব কারখানা চাষীদের কাছ থেকে সবুজ চা-পাতা কিনে চা তৈরি করে। পঞ্চগড়ে উৎপাদিত এই চা নিলাম বাজারে (চট্টগ্রাম ও শ্রীমঙ্গল) বিক্রি করেন কারখানা মালিকেরা। কৃষকদের অভিযোগ এসব কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে চাষীরা দিন দিন লোকসানের দিকে যাচ্ছে।
১৯৬৮ সালে পঞ্চগড় সুগারমিল চালু হয়ে ক্রমাগত লোকসান দেওয়ার পর আসলে এই অঞ্চলে চা শিল্প বিকাশে ছোট পরিসরে আলোচনা শুরু হয়। ওই সময়ে আখ চাষে লোকসানের পর ২০০৮ সালে ৩৬ একর জমিতে চা বাগান গড়ে তোলেন তেঁতুলিয়া উপজেলা সদরের বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী মাহবুর রহমান।
শুরুতে এই শিল্পে সম্ভাবনার হাতছানি দেখে এলেও এখন লোকসানের শঙ্কায় রয়েছেন তিনি। কাজী মাহবুবের ভাষ্য, 'তেঁতুলিয়ার পাশেই ভারতের দার্জিলিংয়ে বহু চা বাগান রয়েছে। তাদের চা-ও বিশ্ববিখ্যাত। আমরাও ভালো কোয়ালিটির চা উৎপাদন করি। কিন্তু সঠিক মূল্য পাই না। এখন এক কেজি কাঁচা চা পাতা উৎপাদনে খরচ হয় ১৮ টাকা। অথচ বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে ১৪ টাকায়। এই দামের মধ্যে আবার প্রতি মণে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পাতার দাম কেটে নেয় কারখানাগুলো। তার মানে কৃষকরা প্রতি কেজি চা পাতায় ৭ থেকে ৮ টাকা পায়। আবার কারখানায় চা পাতা বিক্রি করা ছাড়া আমাদেরও উপায় নেই। কারণ চা পাতার ক্রেতা সবাই নয়। ফলে কৃষকরা দিনের পর দিন লোকসানের শিকার হচ্ছেন।'
সমতলের চা শিল্পে অন্তত ৩০ হাজার শ্রমিক জড়িত রয়েছেন। ক্ষুদ্র চা চাষী রয়েছে অন্তত ৮০ হাজার। কৃষকেরা বলছেন, ১৫ বছর আগে ৩৯ টাকা কেজি পাতা বিক্রি হয়েছে। এখন পাতা ১৪ টাকা কেজি। এরপরও চা বোর্ড নিয়মিত প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে, আগামী মৌসুম বা সামনের দিনে দাম বাড়বে। প্রান্তিক চাষীরা যত্নে গড়া চা বাগান আশায় আশায় রেখে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, বোর্ড কর্মকর্তাদের দেখানো লাভের আশায় উত্তরাঞ্চলে দিন দিন চা বাগানের সংখ্যাও বাড়ছে।
পার্বত্য ও সিলেট অঞ্চলের পর তৃতীয় বৃহত্তম চা উৎপাদন অঞ্চল পঞ্চগড়। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পঞ্চগড়ের চা যাচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে। কৃষকদের উৎপাদিত চা আন্তর্জাতিক বাজারে গেলেও তার সুফল তারা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ অনেক দিনের। উৎপাদন খরচের তুলনায় কাঁচা চা পাতার দাম করার বিষয়ে বাগান মালিকরা মানববন্ধন, স্মারকলিপিসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। তাদের অভিযোগ, পঞ্চগড়ের চা শিল্প এখন চা প্রক্রিয়াকরণের একটি গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি।
২০০১ সালে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার লোহাকাচির শালবাগানে ৫০ এককের বেশি জমিতে চা বাগান করেন দিনাজপুরের ব্যবসায়ী রেজুয়ানুল হক। তারা উৎপাদনে যান ২০০৫ সালে। তখন থেকে শুরু করে ২০১৫ সালের আগ পর্যন্ত একবার ৩৯ টাকা কেজি চা পাতা বিক্রি করতে পেরেছেন। এরপর বিভিন্ন অজুহাতে কারখানা মালিকরা চা পাতায় কর্তনসূত্রের কাঁচি চালায়। দামও কমতে থাকে পাতার।
এই প্রতিষ্ঠানের শুরু থেকেই ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করছেন আব্দুল জব্বার। তিনি বলেন, 'এখন কারখানা মালিকগুলো পিক টাইমে (মে-অক্টোবর) বেশি পাতা কিনছে না। তখন এই কারখানা থেকে ওই কারখানায় ঘুরতে হয় চাষীদের। একসময় বাধ্য হয়ে কম দামে বেশি কর্তনে (ভেজা পাতার অজুহাতে ১০০ কেজিতে ২০ থেকে ৪০ কেজির দাম কম দেওয়া) বিক্রি করতে হয়। এভাবে চা বাগান মালিকরা টিকে থাকতে পারবে না।'
কাঁচা চা পাতা অন্তত ২০ টাকা কেজি হলে কৃষক বা চাষীদের লোকসান হবে না। কিন্তু গত এক (১৭-২৪ অক্টোবর) সপ্তাহ পঞ্চগড়ে ১৪ থেকে ১৬ টাকার মধ্যে পাতা কিনেছে কারখানাগুলো। অথচ সরকারিভাবে এই সময়ে পাতার দাম ১৮ টাকা কেজির উপরে নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু কারখানাগুলো এই নিয়মের তোয়াক্কা করে না।
প্রায় ৫০ একর জমিতে তেঁতুলিয়ার সরকার পাড়ায় অবস্থিত জেড এন্ড জেড চা বাগানে গত ৫ বছর ধরে হিসাব শাখায় ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে রয়েছেন মো. রাসেল। তিনি জানান, 'এই বাগান পাতা উৎপাদনে যাওয়ার পর ৯ মাস নিজের খরচে চলতে পারে। বাকি তিন মাস বাগান মালিক ভর্তুকি দিয়ে চালান। পাতার দামের কারসাজির কারণে আর বাগান টিকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়ে আমরা কারখানা স্থাপন করতে যাচ্ছি। নিজের কারখানা না থাকলে এখন কোনো বাগান মালিক-ই চা পাতা উৎপাদন করে পুঁজি রক্ষা করতে পারবে না।'
চাষীরা বলছেন, এখন প্রতি কেজি পাতা ১৪ টাকা কেজি করে বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে কেজি প্রতি শ্রমিক খরচ রয়েছে তিন থেকে সাড়ে তিন টাকা। কর্তন করে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ। তার মানে সব বাদ দিলে প্রতি কেজি পাতায় কৃষকের থাকছে ৬ থেকে ৭ টাকা। বিপরীতে এখন সার, কীটনাশকসহ কারখানায় ব্যবস্থাপনার খরচ হু হু করে বাড়ছে। এই অবস্থায় বাঁচতে হলে পাতার দাম বৃদ্ধি ও নিলাম কেন্দ্র পঞ্চগড়ে হওয়া খুব জরুরি।
তবে পাতার দাম কমের সাথে কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেট দায়ী নয় বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ ব্রটলিফ টি ফ্যাক্টরি অনার্স অ্যাসোসিয়েশনের পঞ্চগড় জেলার সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, 'চা পাতা তোলার নিয়ম হচ্ছে দুটি পাতা একটি কুঁড়ি অথবা তিনটি পাতা একটি কুঁড়ি। কিন্তু এখানকার চাষীরা কাস্তে দিয়ে কেটে ৫ থেকে ৬ পাতাও কেটে নিয়ে আসে। এ কারণে পাতার দাম কম হয়। হাতে পাতা তুললে এমন সংকট হতো না। বর্তমানে নিলাম মার্কেটে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কৃষকদের সঠিক দাম দিতে পারছি না। তার দাবি, এরপরও চাষীরা লাভবান হচ্ছেন।'
পাতার দামে কৃষকেরা যে সংকটে রয়েছেন তা চা বোর্ডের কর্মকর্তারাও জানেন। পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শামীম আল মামুন বলেন, 'পঞ্চগড় অঞ্চলে চা চাষীদের কিছু সংকট রয়েছে। পাতার দাম কম কিংবা চায়ের জাতেরও বিপত্তি রয়েছে। এগুলো নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। অনেক সময় চাষীরা চা পাতার নির্ধারিত দাম পান না। এর বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন, চা বোর্ড অভিযান পরিচালনা করে।'
চায়ের নিলাম কেন্দ্র পঞ্চগড়ে হলে সংকট অনেকটা দূর হবে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা। শামীম আল মামুন বলেন, 'খুব দ্রুতই পঞ্চগড়ে চা নিলাম কেন্দ্র হবে। চা পাতা ভালো করা গেলে সম্ভাবনা আরও বাড়বে। চা পাতা সংক্রান্ত একটি অ্যাপস রয়েছে; সেখান থেকে চাষীরা ভালো ইনফরমেশন নিতে পারে। সম্ভাবনাময় শিল্পের কারণে দিন দিন উত্তরাঞ্চলে চা চাষ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২১ বছর পার করে এই অঞ্চলের চা শিল্প এখন সফলতার দ্বারপ্রান্তে।'
চা পাতায় কর্তন কিংবা নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম দামে পাতা কিনলে কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম। তিনি জানান, চা পাতার দাম ঠিক রাখতে মোবাইল কোর্ট নিয়মিত কাজ করছে।