ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নৌকা ভাড়ার ব্যবসায় ভাটা
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার প্রত্যন্ত জনপদ অরুয়াইল ও পাকশিমুল। এ দুই ইউনিয়নের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। তবে এখানকার অর্থনীতির আমূল পাল্টে দিয়েছে স্টিল বডির নৌকা ও বাল্কহেড ভাড়ার ব্যবসা। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এনেছে মানুষের ঘরে ঘরে। নৌকা ভাড়ার ব্যবসা থেকে প্রতি মাসে প্রায় সাড়ে ৭ কোটি টাকা আয় করে অরুয়াইল ও পাকশিমুল ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের মানুষ।
তবে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা সমস্যায় অধিকাংশ নৌকা এখন অলস পড়ে থাকছে নদীর ঘাটে। এতে করে মালিকরা যেমন আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন, তেমনি কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অনেক শ্রমিক। সর্বোপরি দুর্বল হয়ে পড়ছে অরুয়াইল ও পাকশিমুল ইউনিয়নের অর্থনীতি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরাইল উপজেলার অরুয়াইল ও পাকশিমুল ইউনিয়নে প্রায় ৭০ হাজার মানুষের বসবাস। একসময় এসব মানুষের জীবিকার একমাত্র উৎস ছিল কৃষিকাজ। আর তুলনামূলক স্বচ্ছল পরিবারের কেউ কেউ অরুয়াইল বাজারে বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসা করতেন। তবে নব্বই দশকে ভাগ্য বদল শুরু হয় দুই ইউনিয়নের মানুষের।
অরুয়াইল ইউনিয়নের রানীদিয়া গ্রামের কয়েকটি পরিবার স্টিল বডির নৌকা ও বাল্কহেড তৈরি করে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মালামাল পরিবহনের ব্যবসা শুরু করেন। একেকটি নৌকা তৈরিতে খরচ হয় ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত। এসব নৌকা ও বাল্কহেড দিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ইট, বালু, সিমেন্ট, পাথর ও রডসহ বিভিন্ন পণ্য পরিবহন করা হয়। ব্যবসাটি লাভজনক হওয়ায় ধীরে ধীরে অরুয়াইল ও পাকশিমুল ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের মানুষজন এতে যুক্ত হন।
এখন দুই ইউনিয়নের বাসিন্দাদের স্টিলের নৌকা ও বাল্কহেড আছে প্রায় ৫০০। এর মধ্যে শুধুমাত্র রানীদিয়া গ্রামেরই আছে প্রায় ৩০০। একেকটি নৌকা ও বাল্কহেড থেকে ভাড়া বাবাদ মাসে এক থেকে দেড় লাখ টাকা আয় করেন মালিকরা। নৌকা ভাড়ার এ ব্যবসায় কর্মসংস্থান হয়েছে স্থানীয় হাজারো বেকার যুবকের।
তবে সম্প্রতি নৌকা ভাড়ার এ ব্যবসায় ভাটা পড়েছে। মালিকদের আয় নেমে এসেছে অর্ধেকে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও নৌপথে চাঁদাবাজির কারণে অধিকাংশ সময় নৌকাগুলো অলস পড়ে থাকছে তিতাস নদীর অরুয়াইল বাজার ঘাটে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর মালিকরা ভাড়া বাড়ানোর কারণে এখন নৌকাগুলো ভাড়া হচ্ছে কম। এছাড়া পুলিশি হয়রানির অভিযোগও রয়েছে নৌকা মালিক-শ্রমিকদের।
কয়েকজন নৌকা মালিক জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সিলেট এবং সুনামগঞ্জে মালামাল নিয়ে যাওয়ার সময় ঘাটে-ঘাটে চাঁদা দিতে হয়। এতে করে ভাড়ার তুলনায় খরচ মিটিয়ে লাভ হয় না। এছাড়া লাইসেন্সসহ নানা অজুহাতে হয়রানি করে নৌ-পুলিশ।
রানীদিয়া গ্রামের নৌকা কারিগর দানিশ মিয়া জানান, তিনি নৌকা তৈরি এবং মেরামত করে প্রতি মাসে ৩০-৩৫ হাজার টাকা আয় করতেন। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে কাজ অর্ধেক কমে গেছে। বর্তমানে মাসে ১০-১২ হাজার টাকার বেশি আয় করতে পারছেন না। এতে করে পরিবার চালাতে কষ্ট হচ্ছে।
রানীদিয়া গ্রামের নৌকা মালিক মুর্শিদ মিয়া জানান, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লেও নৌকার ভাড়া তেমন বাড়েনি। ১ কোটি টাকা দিয়ে বানানো নৌকা এখন ঘাটে ফেলে রাখতে হচ্ছে। চাঁদাবাজি ও পুলিশি হয়রানির কারণে শ্রমিকরা নৌকা নিয়ে যেতে চায় না।
আরেক নৌকা মালিক সিরাজ মিয়া বলেন, "নৌকা ভাড়ার ব্যবসার মাধ্যমে অরুয়াইল ও পাকশিমুল ইউনিয়নের চিত্র পাল্টে গিয়েছিল। কিন্তু জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও ঘাটে-ঘাটে চাঁদাবাজির কারণে এই ব্যবসা এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আর এটি যদি ধ্বংস হয়, তাহলে এই অঞ্চলের মানুষের আয়ের আর কোনো পথ থাকবে না।"
অরুয়াইল স্টিল বডি নৌকা মালিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. আবু তালেব বলেন, "আমাদের দুই ইউনিয়নের নৌকা মালিকরা ভাড়া বাবদ ৬-৭ কোটি টাকা আয় করেন। কিন্তু এখন ব্যবসা মন্দা। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর নৌকার ভাড়া কিছুটা বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু এতে করে নৌকাগুলো ভাড়া হচ্ছে কম। ফলে ঘাটে অলস পড়ে থাকছে অধিকাংশ নৌকা। এছাড়া সিলেটের গোয়াইনঘাট ও সুনামগঞ্জের ছাতকসহ কয়েকটি পয়েন্টে চাঁদা দিতে হয়। তাছাড়া লাইসেন্সের জন্য পুলিশ হয়রানি করে।"
"জ্বালানি তেলের দাম যদি না কমানো হয় এবং চাঁদাবাজি ও পুলিশি হয়রানি বন্ধ না হলে নৌপথে পণ্য পরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হবে। এতে করে নৌকা ভাড়ার ব্যবসা বন্ধ হয়ে পথে বসবে হাজারো মালিক-শ্রমিক", উল্লেখ করেন আবু তালেব।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নৌপুলিশের কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের পুলিশ সুপার মো. মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, "একসময় নৌকা মালিক-শ্রমিক সমিতির নাম করে টোকেনের মাধ্যমে চাঁদাবাজি হতো। তবে এখন সেটি বন্ধ করা হয়েছে। পুলিশের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে তিনজন পুলিশ সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "নৌপথ অনেক বিস্তৃত জায়গা। এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে দৃষ্টি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা কিছুটা কঠিন। আমাদের নৌযানের স্বল্পতা আছে। এর ফলে মানুষ যেমন প্রত্যাশা করে, তেমন পরিপূর্ণভাবে নজরদারি করতে পারি না। যদি নৌযানের ঘাটতি পূরণ হয়, তাহলে নজরদারি বাড়ানো যাবে এবং চাঁদাবাজির ঘটনাগুলোর অবসান ঘটবে।"