এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায়ে ব্যয়বহুল শিক্ষা ব্যবস্থা: ৪র্থ শিল্প বিপ্লবেও পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকিতে বাংলাদেশ
বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির প্রসার ও ডিজিটালাইজেশনের প্রভাব কর্মসংস্থানে পড়লেও বাংলাদেশে ৯০-এর দশক থেকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষার্থীদের সংখ্যা খুব বেশি বাড়েনি।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে শূন্যপদ পূরণে হিমশিম খাচ্ছেন নিয়োগকর্তারা। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়েও বিজ্ঞান বিভাগের বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থী সংকট দেখা দিচ্ছে।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)-এর তথ্যানুসারে, ১৯৯০ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৪২ শতাংশ ও ২৮ শতাংশ। অন্যদিকে মানবিকের ক্ষেত্রে তা ছিল ৫৭ শতাংশ ও ৫২ শতাংশ।
২২ বছর পর এসএসসি ও এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীর সংখ্যা যথাক্রমে ৩২ ও ২৪ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে মানবিক বিভাগের ক্ষেত্রে এসএসসি ও এইচএসসিতে তা বেড়ে যথাক্রমে ৫০ শতাংশ ও ৫৭ শতাংশে পৌঁছেছে।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও নিয়োগদাতারা বলছেন সরকারের উচিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থায় মনোযোগ দেওয়া। এই বিভাগে শিক্ষার্থীদের কম আসার আরেকটি কারণ হলো শিক্ষা সংশ্লিষ্ট উচ্চ ব্যয়।
ভোলার হাফিজ ইব্রাহীম কলেজের বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ জিহাদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তিনি ভালো ফলাফল করার আশায় এই বিষয় নিয়েছেন।
ইব্রাহীম আরও বলেন, 'আমার বাবার আর্থিক অবস্থা খুব বেশি ভালো নয়। আর তাই বিজ্ঞানের বিষয়গুলো বোঝার জন্য কয়েকজন প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ার সামর্থ্যও আমার নেই'।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা উভয়ই জানায় এসএসসি ও এইচএসসিতে বিজ্ঞান নিলে টিউশন খরচে বাড়তি পাঁচ হাজার টাকা লাগে, যা বহন করা দেশের বেশিরভাগ মানুষের জন্যই কঠিন।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, দেশে বিজ্ঞান শিক্ষা বেশ ব্যয়বহুল। যোগ্য শিক্ষকের অভাবেও এই বিভাগে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কম।
কর্মসংস্থানের দিকে নজর দিলে এই সমস্যাগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বিবিএস ক্যাবলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আবু নোমান হাওলাদার টিবিএসকে জানান, প্রতিষ্ঠানটি দক্ষ জনবলের ঘাটতিতে ভুগছে। অন্যদিকে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের মানও ভালো নয়।
তিনি বলেন, 'আমাদের প্রতিষ্ঠান সাধারণত ভারত ও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি নিয়োগ করে কারণ বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যোগ্য ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করতে পারে না।'
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই)-এর সভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিন বলেন, উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দক্ষ জনবলের অভাব বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশে উচ্চশিক্ষিত তরুণের অভাব না থাকলেও শিল্পখাতে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে। তাই বিভিন্ন ব্যবস্থাপক পদের জন্য উদ্যোক্তাদের বিদেশিদের ওপর নির্ভর করতে হয় বলে জানান এফবিসিসিআই সভাপতি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. এএসএম মাকসুদ কামাল টিবিএসকে বলেন, যোগ্যতাসম্পন্ন স্নাতক তৈরির লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষ থেকে সাত হাজার আসনের মধ্যে এক হাজারের বেশি আসন কমিয়েছে।
'আমাদের লক্ষ্য একটি দক্ষ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি করা। সেজন্যই আমরা চাহিদা কম এমন বিষয়গুলোতে আসন সংখ্যা কমিয়েছি,' বলেন তিনি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব দরজায় কড়া নাড়ছে। ফলে মানবিকের চাহিদা কমছে এবং বিজ্ঞান শিক্ষার চাহিদা বাড়ছে।
দেশে বিজ্ঞান শিক্ষা সম্প্রসারণে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী না থাকার প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও দেখা যাচ্ছে।
দেশের একমাত্র উচ্চশিক্ষা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)-র ৪৭তম বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, সমস্ত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাত্র ১১ শতাংশ শিক্ষার্থী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শাখায় পড়ছে, যেখানে কলা, সামাজিক বিজ্ঞান, ব্যবসায় অধ্যয়ন ও অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ৮৯ শতাংশ।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কমছে। ২০১৯ ও ২০২০ সালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১১ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে এই হার ছিল যথাক্রমে ১১ ও ১২ শতাংশ। ২০১৭ সালেও এই হার ১২ শতাংশ ছিল।