মহামারির সময় যেভাবে তড়িৎগতিতে কুরিয়ার পরিষেবার উত্থান
২০১৯ সালে যাত্রা শুরু করে ডেলিভারি টাইগার। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকা কুরিয়ার পরিষেবা বাজারে জায়গা নেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে আসে নতুন এই স্টার্ট আপ। কয়েক মাস পরেই শুরু হয় কোভিড-১৯ মহামারি। এরপর আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। বেড়ে চলে টাইগারের গ্রাহক সংখ্যা।
'আমরা কখনই ভাবিনি যে ডেলিভারি টাইগার মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে এত বেশি গ্রাহক পাবে। মহামারি সবকিছু বদলে দিয়েছে। কেনাকাটার জন্য গ্রাহকরা এত দ্রুত অনলাইনে স্থানান্তরিত হয়েছে যে বিদ্যমান কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলোকে দ্রুত বাড়তে থাকা চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হয়েছে', বলেন ডেলিভারি টাইগারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর।
'আমাদের জন্য কোভিড শাপে বর হয়ে এসেছিল। সদ্য যাত্রা শুরু করেও দ্রুত গতিতে আমাদের বিকাশ হয়েছে,' দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন তিনি।
১৯৮৬ সালে যাত্রা শুরু করা এক্সেলসিওর এক্সপ্রেস আগে শুধু ব্যবসায়িক খাতে বিজনেজ-টু-বিজনেজ ডেলিভারি পরিষেবা দিয়ে থাকত। কোভিডের কারণে লকডাউনের সময় তারা সাধারণ গ্রাহকদেরও ডেলিভারি সেবা দেওয়া শুরু করে।
তড়িৎ গতিতে বাড়তে থাকা ডেলিভারি চাহিদার মধ্যে আরও বেশকিছু প্রতিষ্ঠানে এই খাতে প্রবেশ করে। ফলে ২০১৯ সালে মাত্র ১৩০টি ডেলিভারি প্রতিষ্ঠান থেকে চলতি বছর কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫০০টি। কুরিয়ার সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের কাছ থেকে এই তথ্য জানা গেছে।
'এছাড়া যারা আগে থেকেই ডেলিভারির কাজ করছিল, সেসব প্রতিষ্ঠানও অটোমেশনের দিকে ঝুঁকে। সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যবসায়ী গ্রাহক ছাড়াও তারা ব্যক্তিপর্যায়ে গ্রাহক পরিষেবা প্রদান শুরু করে,' বলেন অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট হাফিজুর রহমান পুলক।
এই খাতে এখন পর্যন্ত বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় পাঁচ হাজার টাকা বলে জানান তিনি। এর ফলে প্রত্যক্ষভাবে এক লাখ ও পরোক্ষভাবে আরও ৪ লাখ কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। এই খাতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ২০ শতাংশে এসে দাঁড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
'আমাদের এখনও ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এমনকি আন্তর্জাতিক কুরিয়ার পরিষেবা শুরু করাও অসম্ভব নয়,' বলেন হাফিজুর। তিনি আরও বলেন কুরিয়ার পরিষেবা উন্নীত হওয়ায় সব ধরনের ব্যবসায়ীরা সহজে পণ্য পৌঁছে দিতে পারছে। কাঁচামালও সময়মতো পাচ্ছেন তারা।
'তবে লজিস্টিকস ও সক্ষমতা বাড়াতে আমাদের এখনও অনেক বিনিয়োগ প্রয়োজন,' বলেন তিনি।
১৯৮৩ থেকে শুরু হওয়া এক যাত্রা
দেশে বেসরকারি কুরিয়ার পরিবহন সেবা চালু হয় ১৯৮৩ সালে। এসময় সুন্দরবন, কন্টিনেন্টাল ও ড্রিমল্যান্ড নামে তিনটি কুরিয়ার প্রতিষ্ঠান বাজারে প্রবেশ করে।
তবে রাষ্ট্রচালিত ডাক বিভাগ এই প্রতিষ্ঠানগুলো চালুর বিরোধিতা করে। অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনার দায়ে তারা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করে। তবে রায় শেষ পর্যন্ত বেসরকারি কুরিয়ার সংস্থাগুলোর পক্ষেই আসে,' বলেন হাফিজুর।
তখন থেকেই দেশের কুরিয়ার খাত উত্তরোত্তর বিকাশের মুখ দেখেছে।
শীর্ষ প্রতিষ্ঠান কারা
দেশের সবচেয়ে পুরোনো সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস এখন এই খাতে দেশের সবচেয়ে বৃহত্তম অংশীদার। বাজারের ৪০ শতাংশই এখন তাদের দখলে। কুরিয়ার সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মতে, এর পরেই আছে এসএ পরিবহন, করতোয়া, রেডএক্স এবং জননী এক্সপ্রেস।
সবগুলো সংস্থা মিলে গড়ে দৈনিক প্রায় সাড়ে সাত লাখ ডেলিভারি দিয়ে থাকে। এর মধ্যে শুধু সুন্দরবনই তিন লাখ ডেলিভারি সেবা দেয় বলে জানান অ্যাসোসিয়েশনের অফিস সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম।
'শুরু থেকেই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করায় আমরা শীর্ষ অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছি,' বলেন সুন্দরবন কুরিয়ারের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হাফিজুর রহমান পুলক।
বেড়েছে বিশ্বস্ততা
পণ্য পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে গ্রাহকদের বিশ্বস্ততা অর্জনে কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলোকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে।
'একসময় আমাদের ব্যবসা শুধু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে কুরিয়ার ডেলিভারি প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সরাসরি গ্রাহকদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার পরিষেবা আরও দেরীতে শুরু হয়। ই-কমার্সের বৃদ্ধির সঙ্গে দ্রুত গতিতে তা বাড়তে থাকে,' বলেন নুরুল ইসলাম। মানুষের বিশ্বস্ততা অর্জন এই খাতকে সমৃদ্ধ হতে সাহায্য করেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ডেলিভারির আগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অনেক প্রতিষ্ঠানই পার্সেল স্ক্যানিং পদ্ধতি বেছে নেয়। কেউ যেন ড্রাগ বা অন্য কোনো অবৈধ জিনিস লেনদেন করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে স্ক্যানিং ব্যবস্থা রাখার কথা ব্যাখ্যা করেন তিনি।
'এছাড়া অনিয়ম ঠেকাতে আমরা সব লেনদেনকে ব্যাংকিং ব্যবস্থার আওতায় আনার পদক্ষেপ নিয়েছি। এ লক্ষ্যে গত অক্টোবরে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে,' জানান তিনি।
কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে চ্যালেঞ্জ
উত্তরোত্তর বিকাশ ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
'অবৈধ পার্সেল, চোরাকারবারি ঠেকাতে আমরা স্ক্যানিং ব্যবস্থা হাতে নিলেও চোরাকারবারিরা আমাদের চোখ এড়াতে বিকল্প খুঁজে বের করেছে,' বলেন হাফিজুর রহমান পুলক।
'আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো পার্সেল আটক করলে আমাদের নির্দোষ কর্মকর্তাদেরও হয়রানির শিকার হতে হয়'।
এছাড়া স্ক্যানিং মেশিনের দামও অনেক বেশি। প্রায় ৫০ লাখ থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত দাম হয়ে থাকে এসব মেশিনের। সবার পক্ষে এগুলো ব্যবহার করা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।
'এছাড়া আমাদের বার্ষিক লাইসেন্স নবায়ন ফি অনেক বেশি। যা ৫০ হাজার থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। তার ওপর কর্তৃপক্ষ কোনো সেবা না দিয়েই আমাদের কাছ থেকে সার্ভিস চার্জ আদায় করছে,' অভিযোগ হাফিজুরের।
'আরেকটি বড় হতাশা হল যে কুরিয়ার ব্যবসা পরিষেবা শিল্পখাতের তালিকাভুক্ত নয়। এসব কারণে আমরা কর রেয়াতসহ অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি,' বলেন তিনি।