ফেসবুকে ৪৭ শতাংশ নারী সহিংসতার শিকার: সমীক্ষা
চলতি বছরে দেশে বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মধ্যে নারীরা সবচেয়ে বেশি সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছেন ফেসবুকে, যা ৪৭ দশমিক ৬০ শতাংশ। দেশে অনলাইন সহিংসতার হার জানার জন্য একশনএইড বাংলাদেশের সমীক্ষায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
নারীরা জানিয়েছেন ম্যাসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইউটিউবে অনলাইন সহিংসতার সম্মুখীন হন তারা। ৪ দশমিক ৮০ শতাংশ নারী বলেছেন, তারা ভিডিও কল, মোবাইল ফোন এবং এসএমএস এর মাধ্যমে হয়রানির সম্মুখীন হয়েছেন।
সাতক্ষীরা, সুনামগঞ্জ, পটুয়াখালী, বান্দরবান, কুড়িগ্রাম এবং লালমনিরহাট– এই ছয়টি জেলায় একটি অনলাইন জরিপের মাধ্যমে সমীক্ষাটি পরিচালিত হয়, যেখানে ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ৩৫৯ জন নারী অংশ নেন।
রোববার (২৭ নভেম্বর) ১৬ দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ উদযাপন উপলক্ষে ব্র্যাক সেন্টার ইন-এ একশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত 'অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা: বাধা এবং উত্তরণের উপায়' শীর্ষক আলোচনা সভায় সমীক্ষার এই ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
এসময় বলা হয়, এই সমীক্ষাটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নারীদের দ্বারা অনুভূত বিভিন্ন ধরণের সহিংসতা এবং হয়রানি চিহ্নিত করার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এবং এর পেছনের মূল কারণ এবং অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়ে সচেতনতার জন্য বিভিন্ন পন্থা উপস্থাপন করে।
একশনএইড এই সমীক্ষা অনুসারে, ৬৩ দশমিক ৫১ শতাংশ নারী উত্তরদাতারা বলেছেন, তারা অনলাইন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। গত বছরে যা ছিল ৫০ দশমিক ১৯ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় অনলাইনে সহিংসতা বেড়েছে।
প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৬৪ জন নারীকে অনলাইন হয়রানি ও সহিংসতার সম্মুখীন হতে হয়।
এছাড়াও এ বছরের সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে, ৮০ দশমিক ৩৫ শতাংশ নারী অনলাইন সহিংসতার মধ্যে ঘৃণ্য ও আপত্তিকর যৌনতাপূর্ণ মন্তব্য; ৫৩ দশমিক ২৮ শতাংশ নারী ইনবক্সে যৌনতাপূর্ণ ছবি গ্রহণ এবং যৌন সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব; ১৯ দশমিক ১৭ শতাংশ নারী বৈষম্যমূলক মন্তব্যের শিকার হয়েছেন।
১৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ উত্তরদাতারা বলেছেন, তাদের নামে অন্য কেউ অনলাইনে নকল আইডি তৈরির ফলে হয়রানির শিকার হয়েছেন।
১৬.১৬ শতাংশ বলেছেন, তাদের কার্যকলাপ সবসময় সাইবার স্পেসে অনুসরণ করা হয়। ১৩.১০ শতাংশ সমকামীদের অধিকার নিয়ে কথা বলার জন্য ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
১১ দশমিক ৭৯ শতাংশ বলেছেন, তাদের ব্যক্তিগত ছবি অনুমতি ছাড়াই সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করা হয়েছে এবং ১১ দশমিক ৭৯ শতাংশ যৌন নিপীড়নের হুমকি পেয়েছেন।
সমীক্ষা মতে, অনলাইন সহিংসতার কারণে নারীদের জীবনে সবচেয়ে গুরুতর প্রভাব হলো, মানসিক আঘাত, হতাশা ও উদ্বেগ; দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রভাব হলো, সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় থাকা বা মতামত প্রকাশ করার ক্ষেত্রে আস্থা হারানো। ২৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ ট্রমার শিকার হয়েছেন এবং ২৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ আত্মমর্যাদা হারিয়েছেন।
সমীক্ষায় আরও প্রকাশ করা হয়েছে, অনলাইন সহিংসতা এবং হয়রানির কারণে সৃষ্ট মানসিক যন্ত্রণা নারীর আত্মবিশ্বাস ও স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে সংকুচিত করছে।
সমীক্ষায় আরও বলা হয়, ১৪.৯১ শতাংশ নারী অনলাইন সহিংসতার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা দিয়েছেন এবং ৮৫ শতাংশেরও বেশি ভুক্তভোগী কোনও অভিযোগ জমা না দিয়ে নীরব ছিলেন, যদিও তারা বিভিন্ন উপায়ে অনলাইনে হয়রানির শিকার হয়েছেন।
অভিযোগকারীদের মধ্যে, ৪৪.১২ শতাংশ সোশ্যাল মিডিয়া রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে, ২০.৫৯ শতাংশ পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের ফেসবুক পেজের মাধ্যমে, ১১.৭৬ শতাংশ জাতীয় জরুরি পরিষেবা (৯৯৯)-এর মাধ্যমে, ১১.৭৬ শতাংশ নিকটস্থ থানায়, ৫.৮৮ শতাংশ সাইবার ক্রাইমের ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন, সিটিটিসি ও ডিএমপি'র মাধ্যমে অভিযোগ দায়ের করেছেন।
অনুষ্ঠানে একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, "নারীর প্রতি সহিংসতা নতুন কিছু নয় এবং এটি এখনও বিভিন্ন মাধ্যমে বিদ্যমান রয়েছে। পরিবার, সামজ, রাষ্ট্র– প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী নির্যাতন হচ্ছে এবং এর নানা রকম বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে। এর নতুন এক মাধ্যম হলো অনলাইন। এই প্রযুক্তির যুগে অনলাইনে নারীদের প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।"
"বিশেষ করে কিশোরী ও ১৮ বছরের নিচের কন্যা শিশুরা এর শিকার হচ্ছে বেশি। সবাই একত্রিত হয়ে কাজ করলে নারীর প্রতি সহিংসতা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব," বলেন তিনি।
এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের সহকারী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমিন অনলাইন সহিংসতা নিরসনে আইনী প্রক্রিয়ার জোরদারের পাশাপশি প্রযুক্তিগত সহায়তা বেশি দরকার বলে অভিমত প্রকাশ করেন।
আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার বিজয়ী এবং সাইবার টিনস ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি সাদাত রহমান বলেন, "বাংলাদেশে অনলাইন হয়রানির কারণে গত ২ বছরে ১১ জন তরুণী আত্মহত্যা করেছে। কিশোর-কিশোরীরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে সচেতন, কিন্তু তারা জানে না কীভাবে সহায়তা পেতে হয়।"
আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সহায়তা ব্যবস্থাকে আরও সহজলভ্য করতে হবে বলে জানান তিনি।