৩৭ বছর পর চট্টগ্রাম থেকে অপসারিত হলো বিষাক্ত ডিডিটি'র বৃহত্তম মজুদ
মানবদেহ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিকগুলোর অন্যতম ডাইক্লোরো-ডাইফেনাইল-ট্রাইক্লোরোইথেন (ডিডিটি)। অথচ ১৯৮৫ সালে পাকিস্তান থেকে আনা ৫০০ টন ডিডিটি গত ৩৭ বছর রক্ষিত ছিলো চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদে সরকারি মেডিকেল সাব ডিপোতে। বুধবার বিষাক্ত ডিডিটি'র সর্বশেষ চালানটি ফ্রান্সে পাঠানোর জন্য কনটেইনার ডিপোতে পাঠানোর মাধ্যমে শেষ হলো বাংলাদেশে এ ক্ষতিকর রাসায়নিকের অধ্যায়।
এদিন চট্টগ্রামের পাঁচতারকা হোটেল রেডিসন ব্লুতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ডিডিটি অপসারণের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়। জটিল আন্তর্জাতিক এ ব্যবস্থাপনাকে নেতৃত্ব দিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)।
পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিমা আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তফা কামাল।
ড. ফারহিমা আহমেদ জানান, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থার (এফএও) তত্ত্বাবধানে এই রাসায়নিক অপসারণ শুরু হয় ২০২০ সালের করোনাকালীন সময়ে। ৩০ নভেম্বর ডিডিটি'র সর্বশেষ চালানবাহী কনটেইনারগুলো ডিপোতে পাঠানো হয়েছে। এর মাধ্যমে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের সিএমএসডির (কেন্দ্রীয় ওষুধাগার) গোডাউনে থাকা ডিডিটি সম্পূর্ণরূপে অপসারিত হয়েছে।
আগামী ২ ডিসেম্বর মাদার ভেসেলে করে ডিডিটির এই চালানটি ফ্রান্সের পাঠানো হবে। এর আগে ৩০ অক্টোবর ও ১৭ নভেম্বর দুটি চালানে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের কেন্দ্রীয় ওষুধাগার গোডাউনে থাকা ডিডিটি ধ্বংসের জন্য ফ্রান্সে পাঠানো হয়।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তফা কামাল বলেন, 'বাংলাদেশে ১৯৮৫ সালে ৫০০ মেট্রিক টন কীটনাশক আমদানি করা হয়েছিল ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহনকারী মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য। এছাড়া চট্টগ্রামের বাড়বকুণ্ডের ক্যামিকেল কমপ্লেক্সে ১০০ টনের মত ডিডিটি ছিলো, যা পরবর্তীতে আগ্রাবাদের কেন্দ্রীয় ওষুধাগার গোডাউনে স্থানান্তর করা হয়। অবশেষে ওই গোডাউনটি সম্পূর্ণভাবে ডিডিটিমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে ডিডিটি অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো।'
তিনি বলেন, '১৪ বছর ধরে এটি সরানো নিয়ে আমরা যুদ্ধ করছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা সফল হয়েছি। চিকিৎসকরা বলছেন চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকার মানুষের ক্যান্সার বেশি হচ্ছে। এমনকি মায়ের দুধেও ডিডিটির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এ প্রভাব জেনারেশন বাই জেনারেশন হতে পারে। তাই চট্টগ্রাম থেকে ডিডিটি অপসারণেই আমাদের কাজ শেষ হয়ে যায়নি। ওই এলাকার মাটি, পানি ও মানুষের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে স্থানীয়দের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।'
এফএও'র সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার মার্ক ডেভিস বলেন, 'সিএমএসডির গোডাউন থেকে শুধু ডিডিটি নয়, ওই গোডাউন ধোঁয়া এক ফোটা পানিও বাংলাদেশে রাখা হচ্ছে না; সবকিছু পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে ফ্রান্সে। এর পাশাপাশি এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে ডিডিটি অপসারণে কাজ করা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও এলাকাবাসীর স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য একটি গবেষণা পরিচালনা করা হবে। তবে প্রায় ৪০ বছর সংক্রমণের পর এলাকাটি সম্পূর্ণভাবে দূষণমুক্ত করা অসম্ভব।'
তিনি বলেন, '৫০০ টন ডিডিটি অপসারাণ করা কিছুটা বিপদজনক ছিলো। তাই আমরা এই কাজ খুব সাবধানে, নিরাপত্তার সব রকম পদক্ষেপ নিয়ে শেষ করেছি। একাজের শুরুতেই ভবনগুলি সিল করে দেওয়া হয়েছিল এবং সব ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক যাতে ভেতরেই থাকে তা নিশ্চিত করা হয়েছিল। পরিবেশে রাসায়নিক যাতে ছড়িয়ে না পড়ে তা নিশ্চিত করতে আমাদের দিক থেকে সমস্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা প্রয়োগ করা হয়েছিল। সেক্ষেত্রে ইউরোপীয় নিরাপত্তা মান প্রয়োগ করা হয়েছিল।'
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মার্ক ডেভিস বলেন, 'ডিডিটি অপসারণে কাজ করা শ্রমিকদের শতভাগ প্রস্তুত করেই এ কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো। তাদের আজীবন বিমার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে, আগামীতে তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি ফলোআপ করা হবে।'
বাংলাদেশে এফএও প্রতিনিধি রবার্ট ডি. সিম্পসন বলেন, 'এটি একটি বড় অর্জন, কিন্তু বাংলাদেশে অন্যান্য কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে এখনও অনেক দূর যেতে হবে। আমরা কীটনাশক ব্যবহারের প্রশাসনিক দক্ষতা ও প্রয়োগকে শক্তিশালী করতে চাই, অবশিষ্ট কীটনাশকের ব্যবহারের ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ ও রিপোর্টিং ব্যবস্থা উন্নত করতে চাই এবং পরিবেশের জন্য কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে চাই।'
১৯৮৫ সালে আমদানি হলেও ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে ডিডিটি উৎপাদন নিষিদ্ধ করা হয়। ২০০১ সালে স্টকহোম কনভেনশনে ডিডিটিসহ ক্ষতিকারক জৈব দূষণকারী কীটনাশক উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ বা সীমিতকরণ সংক্রান্ত একটি চুক্তিতে বাংলাদেশসহ ১৭১টি দেশ স্বাক্ষর করে। ২০০৭ সালের ১২ মার্চ তা কার্যকর করা হয়। এফএও এর গ্রিন এনভায়রনমেন্টাল ফান্ডের ৩০ লাখ ডলার অনুদানে 'পেস্টিসাইড রিস্ক রিডাকশন ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের এসব ডিডিটি ধ্বংসের জন্য ফ্রান্সের প্যারিসে পাঠানো হচ্ছে।