পার্বত্য এলাকায় সংঘাত সৃষ্টি করছে অপরিকল্পিত পর্যটন উন্নয়ন: বিশেষজ্ঞরা
পার্বত্য চট্টগ্রাম (সিএইচটি) এলাকায় অপরিকল্পিত পর্যটন উন্নয়ন ও সড়ক উন্নয়নের কারণে নানা সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা।
শনিবার রাজধানীর বনানীর ঢাকা গ্যালারিতে এডিটরস গিল্ড বাংলাদেশের 'পার্বত্য শান্তি চুক্তি:বাস্তবায়ন ও চ্যালেঞ্জ' শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে একথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম। দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক এবং এডিটরস গিল্ডের প্রেসিডিয়ামের অন্যতম সদস্য শ্যামল দত্তের সঞ্চালনায় বৈঠকে অংশ নেন সরকারের সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা।
ড. সাদেকা হালিম বলেন, "চুক্তির পরে পর্যটনের জন্য যেভাবে দরজা খোলা হয়েছে তাতে সে এলাকার আদিবাসীদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ব্যবস্থাপনা অন্যসব সাধারণ ভূমি ব্যবস্থাপনার মতো হলে জটিলতা তৈরী হবে। তাদের জন্য একটি সূত্র বের করতে হবে। ট্যুরিজম পরিকল্পিতভাবে করা উচিত এবং পার্বত্য এলাকায় সেটা করা সহজ।"
তিনি বলেন, "আদিবাসী নারীরাও পার্বত্য এলাকায় বিভিন্ন সহিংসতার শিকার হচ্ছে। চুক্তিতে ছিল যারা পুলিশে চাকরি পাবেন আদিবাসী নারীরা সেই এলাকায় দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। কিন্তু তাদেরকে বিভিন্ন সিটিতে পোস্টিং দেওয়া হচ্ছে। নিজস্ব এলাকায় দেওয়া হচ্ছে না।"
ড. সাদেকা হালিম বলেন, "আদিবাসীরা যারা চুক্তি করেছিলেন তারাও বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়েছে। চুক্তির কতোগুলো মৌলিক বিষয় আছে। একটি অবজেকটিভ সাইড এবং একটি সাবজেকটিভ সাইড। তখন এমন একটি চুক্তি ছিল যেখানে তৃতীয় কোনো পক্ষ ছিল না। তখন উদ্যোগটি ছিল অত্যন্ত অভিনন্দনযোগ্য। এর জন্য প্রধানমন্ত্রী তখন পুরস্কারও জিতেছিলেন। চুক্তির লক্ষ্য হচ্ছে আঞ্চলিক পরিষদ, তারাই হবে মূল এবং এর সাথে জেলা পরিষদ যেগুলো আছে সেগুলো। তারাই কিন্তু এ চুক্তি বাস্তবায়নে কাজ করবে সরকারের সাথে।"
শ্যামল দত্ত বলেন, "২৫ বছর আগে, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনগোষ্ঠীর জন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের আগে আমরা যে পার্বত্য চট্টগ্রাম দেখেছি এর পরের চিত্র কিন্তু একটি ডিফারেন্ট ফেনোমেনন।"
সরকারের মূল্যায়নে দেখা গেছে, ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি বাস্তবায়ন হয়েছে। ১টি বাস্তবায়নাধীন আছে। ৯টি বাস্তবায়িত হয়নি।
বাংলাদেশ সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, "যারা চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করছে, এ ধরনের অদৃশ্য ফোর্সই পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী। আন্তরিকতা থাকলে চুক্তিগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সাথে সাথে পরিস্থিতি ও সময় আলোকে চুক্তিগুলো সংশোধন করতে হবে।"
তিনি বলেন, "এটি যে অবস্থায় চলে গেছে এর সমাধান করা খুবই কঠিন। এরপরেও আমার প্রত্যাশা থাকবে এ সমস্যা সমাধানের জন্য সব মহলকে এক হতে হবে।"
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা বলেন, "পার্বত্য চুক্তির পরে অনেকগুলো সংস্থা, প্রতিষ্ঠান হয়েছে কিন্তু এগুলো অনেক দুর্বল। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় হচ্ছে এলাকাভিত্তিক, কোনো বিষয়ভিত্তিক নয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধিক্ষেত্রের মধ্যে শুধুমাত্র আছে আঞ্চলিক পরিষদ, তিন জেলা পরিষদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা সব অন্য মন্ত্রণালয়ের আওতায়। এটার দায় হচ্ছে ক্ষমতায়নের। আগে মন্ত্রণালয়কে শক্তিশালী করতে হবে।"
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুল রশীদ বলেন, "জিও-পলিটিক্যাল (ভূ-রাজনৈতিক) কন্টেক্স আগেও বাহিরে ছিল না এখনও বাহিরে নেই। পরিস্থিতি কখনও এক থাকে না। এটি সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়। সাথে সাথে জিও-পলিটিক্যাল প্লেয়াররাও তাদের কৌশল পরিবর্তন করতে থাকে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সমতলের কিছু মানুষ ওখানে নিয়ে বসানো হয়েছে সেটিও সঠিক ছিল কিনা তা বিবেচনার বিষয়।"
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদ বলেন, "যতো জটিল সমস্যাই হোক সেটি তো এমন না যে ২৫ বছরে সমাধান করা যাবে না। এজন্য সদিচ্ছা থাকতে হবে। সাজেক সবচেয়ে বড় টুরিস্ট প্লেস। সেখানে ত্রিপুরা ও লুসাইদের বসবাস ছিল। তাদেরকে পিটিয়ে-তাড়িয়ে দিয়ে কৃত্রিম লুসাই গ্রাম করেছে এবং সেখানে ট্যুরিস্টদের ঘুরিয়ে দেখায়। চুক্তির মূল উদ্দেশ্যই ছিল সেখানে পাহাড়ের সংস্কৃতি রক্ষা করা হবে, এলাকাটি থাকবে উপজাতিদের অধ্যুষিত।"