৩ দিনের ছুটি ঘিরে পর্যটকের ঢল নামতে চলেছে শ্রীমঙ্গলে
পর্যটন জেলা মৌলভীবাজারে সারাবছর পর্যটকের আনাগোনা থাকলেও, শীত মৌসুমে তা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। আর প্রতি ঈদের ছুটিতে তো রীতিমত ঢল নামে। এবার সাপ্তাহিক ছুটি ও বড়দিনের ছুটি একসঙ্গে (শুক্র, শনি ও রোববার) পড়েছে। সেই সাথে পর্যটনের পিক মৌসুম শীত তো আছেই। সব মিলে এবার ঈদের আগেই পর্যটকের ঢল নামার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে মৌলভীবাজারে।
পর্যটন ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবারের বড়দিনে সব চেয়ে বেশি পর্যটক আসবেন শ্রীমঙ্গলে, স্মরণকালে যেমনটা দেখা যায়নি। ১ মাস আগে থেকেই বুকিং হয়েছে হোটেল-মোটেলগুলো। আর এক সপ্তাহ আগেই প্রায় শতভাগ বুকিং পায় তারা।
ফলে রাজধানীসহ সারা দেশের পর্যটকদের ঢল নামার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের দর্শনীয় স্থানগুলোতে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ অবস্থায় আগে থেকে রুম বুকিং দেয়া না থাকলে বেড়াতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে পর্যটকদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শ্রীমঙ্গলের ৬৭টি হোটেল ও রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ তাদের সব রুমের অগ্রিম বুকিং পেয়েছে। শ্রীমঙ্গলের ৫টি তারকা হোটেলসহ সাধারণ মানের হোটেলগুলোতেও কোথাও কোনো রুম খালি নেই।
শ্রীমঙ্গল পর্যটন সেবা সংস্থার সূত্র জানায়, হোটেল-মোটেলগুলো আগে থেকেই শতভাগ বুক হয়ে গেছে। পূর্বের পরিচিতজনরা ফোন দিয়ে রুম বুকিংয়ের চেষ্টা করলেও আমরা কিছু করতে পারছি না। শেষ সময়ে এসে অনেকেই কয়েকগুণ বেশি ভাড়া দিয়ে রুম নিতে আগ্রহী হলেও, এমন অনেক গ্রাহককে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে।
গ্রিনলিফ রিসোর্টের পরিচালক এস কে দাস সুমন বলেন, আমার এখানে যত রুম আছে, ১৫ দিন আগেই সেগুলো বুকিং হয়ে গেছে। 'এখন পর্যটকরা প্রতিদিনই রুমের জন্য কল দিচ্ছেন। তারা অতিরিক্ত টাকা গুনতেও রাজি, কিন্তু কোনো উপায় নেই'।
'এসকেডি আমার বাড়ি রিসোর্টে'র এমডি সজল দাশ বলেন, এমনটা সাধারণত ঈদের ছুটিতে হয়; কিন্তু, এবার ৩ দিনের ছুটি একসাথে আর শীত পড়ায় মানুষ বেড়াতে আসছে। যেকারণে সব রুম বুকড, এবার রেকর্ড পর্যটক আসবেন বলেই আমার ধারণা। আমার এখানে কোন রুম নেই, পরিচিত অনেকে অনুরোধ করলেও, তাদের ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। প্রথম প্রথম নিজেরা না পারলে অন্য রিসোর্টে তাদের বুকিং পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু এখন কোথাও রুম খালি নেই।
শ্রীমঙ্গল পর্যটন সেবা সংস্থার সাধারণ সম্পাদক শামছুল হক জানান, '২৩-২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো কটেজ খালি নেই। গত এক সপ্তাহ থেকে শত শত ফোন রিসিভ করে একই কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠছি। মাফ চেয়েছি, আমার নিজেরও একটি ইকো-রিসোর্ট রয়েছে। এটিও প্রায় ১৫ দিন আগে থেকেই ফিলআপ হয়ে গেছে'।
তিনি আরো বলেন, 'জানতে পেরেছি শ্রীমঙ্গলের কোথাও হোটেল বা রিসোর্ট (কক্ষ) খালি নেই। ১০ দিন আগেই সব পূর্ণ হয়ে গেছে। তবে পর্যটকদের একটি বড় অংশ আসেন তাৎক্ষণিকভাবে। রুম নিয়ে তাদের বিড়ম্বনায় পড়তে হবে'।
পর্যটকের সম্ভাব্য ঢলে খুশি নতুন বিনিয়োগকারীরা। নির্জন রিসোর্টের পরিচালক ছোটক হক জানান, আমরা ৬ বন্ধু মিলে কিছুদিন আগে এই রিসোর্টটি চালু করেছি। চালুর সাথে সাথে শতভাগ বুকিং পেয়ে আমরা উৎসাহ পাচ্ছি, সেই সাথে আনন্দিত।
এদিকে জেলায় বিপুলসংখ্যক পর্যটক আগমনকে সামনে রেখে নিরাপত্তায় সতর্ক পুলিশ প্রশাসনও।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাসের রিকাবদার জানান, 'এই ছুটিতে অনেক পর্যটক আসবেন। তাদের নিরাপত্তার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। পর্যটকরা যেন নিরাপদে ঘুরতে পারেন, সেজন্য সব ধরনের নিরাপত্তা দিতে আমরা সতর্ক। সেই সাথে সার্বক্ষনিক ট্যুরিষ্ট পুলিশ দায়িত্ব পালন করবে'।
তবে পর্যটকদের আগমনে শংকিত পরিবেশবাদীরা। পর্যটকদের বড় একটি অংশ লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ঘুরতে যান। কিন্তু, অতিরিক্ত পর্যটকের ভিড়ে বন্যপ্রাণীদের স্বাভাবিক চলাফেরা ব্যাহত হয়। গত ঈদুল ফিতরের পরবর্তী চারদিনে এখানে দেশি-বিদেশিসহ মোট ১১ হাজার ২শত ৭১ জন পর্যটক বেড়াতে আসেন। এতে চারদিনে মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে ৫ লাখ টাকার বেশি।
বনে এভাবে বিপুল সংখ্যক পর্যটক আসায় এখানকার জীববৈচিত্র বেশ হুমকির মুখে পড়েছে। ১,২৫০ হেক্টর আয়তনের এ বনটি জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। এখানে রয়েছে ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ ও বন্যপ্রাণী।
পরিবেশবাদী সংগঠন স্ট্যান্ড ফর আওয়ার ইন্ডেঞ্জারড ওয়াইল্ডলাইফের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন এবং পরিবেশ কর্মী খোকন তনাজম জানান, 'যখনই পর্যটক বেশি আসেন তখন একটি কমন চিত্র দেখা যায় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। প্রধান ফটকের সামনে পর্যন্ত থাকে পর্যটকবাহী যানবাহনের ভিড়। ভিতরে প্রবেশ করেই দেখা যায়- পুরো রাস্তা জুড়ে পর্যটকের দীর্ঘ লাইন। সবাই বনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বেশি সংখ্যক লোকসমাগমের কারণে- উচ্চ শব্দ আর যানবাহনের প্রচণ্ড আওয়াজে মনে হবে- এটা কোনো জাতীয় উদ্যান নয়। আবার পর্যটকদের ফেলে যাওয়া পলিথিন আর নানা প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে ক্ষতি হচ্ছে বনের পরিবেশের। মানুষের কোলাহলে, যানবাহনের হর্নের শব্দে বন্যপ্রাণীরা যেমন আতঙ্কিত হয়, অন্যদিকে পরিবেশের ক্ষতি হয় মারাত্মকভাবে। তাই বনে পর্যটন সীমিত রাখা দরকার। এক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে স্থানীয় বন বিভাগ।'
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী জানিয়েছেন, এবিষয়ে আমরা মন্ত্রণালয়ে কথা বলেছি। বর্তমানে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে, পর্যটকদের জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে সচেতন করার এবং যাতে তাদের কর্মকাণ্ডে বনের পরিবেশের কোনো ক্ষতি না হয় সে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।