চট্টগ্রামের ১৫ মহাসড়ক খুলে দিল পর্যটনের অপার সম্ভাবনার দ্বার
বুধবার দেশের ৫০টি জেলায় ১০০ মহাসড়ক উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগের ১৫টি মহাসড়কও। যা দেশের সড়ক যোগাযোগে উন্মুক্ত করেছে এক নতুন দিগন্ত, খুলে দিয়েছে এই অঞ্চলের পর্যটনের অপার সম্ভাবনার দ্বার। বিশেষ করে প্রকৃতির অপার রহস্য পাহাড়ের সঙ্গে সমতলের দারুণ মিতালি গড়ে দিয়েছে এসব সড়ক।
প্রকৃতির কোল ঘেঁষে কক্সবাজারের চকরিয়া থেকে বান্দরবানের লামা উপজেলা পর্যন্ত দীর্ঘ ১৯ কিলোমিটার ইয়াংছা-মানিকপুর-শান্তিবাজার মহাসড়কটি ইতোমধ্যেই সড়ক পর্যটনের অপার সম্ভাবনার ক্ষেত্র হিসেবে দেখা দিয়েছে। প্রতিদিনই দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এই মহাসড়কের দু'পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে ভিড় করছেন।
একই সঙ্গে সড়কটির উন্নয়নের ফলে কয়েকটি উপজেলার সাথে দুই জেলার মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ যেমন নিশ্চিত হয়েছে, তেমনি পাল্টে গেছে অর্থনীতির চাকা। ৫৫ কোটি ২২ লাখ ৯৩ হাজার টাকা ব্যয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগ এই সড়কটি নির্মাণ করে।
স্থানীয়রা বলছেন, ইয়াংছা-মানিকপুর-শান্তিবাজার মহাসড়কটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ায় যানবাহনে কক্সবাজারের চকরিয়া থেকে মাত্র আধঘণ্টায় লামা সদরে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে। শুধু তাই নয়, মানিকপুরের পাহাড়ের ভেতর ও পাদদেশ হয়ে সড়কটি নির্মাণ হওয়ায় পর্যটনেরও অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ইউনিয়নের আরেক পর্যটন স্পট সুরাজপুরের নিভৃতে-নিসর্গ পার্কও প্রিয় পর্যটন স্পট হয়ে উঠেছে।
একইভাবে হাটহাজারী-মাটিরাঙ্গা-খাগড়াছড়ি সড়ক; বারৈয়ারহাট-নারায়ণহাট-ফটিকছড়ি সড়ক, রাউজান-ব্রাহ্মণছড়ি সড়ক; মইজ্জারটেক-বোয়ালখালী-কানুনগোপাড়া-উদরবন্যা সড়ক; বোয়ালখালী উপজেলার প্রীতিলতা সড়ক অবদান রাখবে পর্যটন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে।
চকরিয়ার সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম বলেন, 'দৃষ্টিনন্দন এই সড়কটি নির্মাণের মধ্য দিয়ে আমার ইউনিয়নের মানুষের ভাগ্যের আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এখানকার জমির দামও অনেকগুণ বেড়ে গেছে। টেকসই সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় এখানকার রকমারি সবজি, তামাকসহ বিভিন্ন পণ্য নির্বিঘ্নে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে স্বল্প খরচে পৌঁছানো যাচ্ছে।'
আজিমুল হক বলেন, 'সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে এই সড়কটির মাধ্যমে চকরিয়ার সাথে বান্দরবানের লামার সংযোগ স্থাপন হওয়ায় খুব অল্প সময়েই যাতায়াত করা সম্ভব হচ্ছে। পাশাপাশি সড়কটি ঘিরে মানিকপুরের সেগুন বাগান এলাকায় পর্যটনের অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সুরাজপুরের নিভৃতে-নিসর্গ পর্যটন স্পট এবং এই সড়কটিকে ঘিরে প্রতিদিন প্রচুর দেশি-বিদেশি পর্যটকের আগমন ঘটছে, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখছে।'
বারৈয়ারহাট-নারায়ণহাট-ফটিকছড়ি পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি চট্টগ্রাম জেলার সবচেয়ে উঁচু সড়ক। এ সড়কের প্রতিটি পরতে পরতে লুকিয়ে আছে সৌন্দর্য্য আর রহস্য। এ সড়কটি এত উঁচু যে মনে হবে চলতে চলতে মেঘের দেশে হারিয়ে গেছেন। এ সড়ক থেকে মেঘের ভেসে বেড়ানো, পশ্চিমের বঙ্গোপসাগর, সূর্যাস্ত এবং পূর্বের পাহাড়ি জনপদ সবই দেখা যায় একসঙ্গে।
মীরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝর্ণার উৎসমুখ কিংবা বোয়ালিয়া ট্রেইলের সকল ঝর্ণায় খুব সহজেই এ সড়ক দিয়ে যাওয়া যায়। এছাড়াও এই সড়কের উত্তর এবং দক্ষিণ দুই পাশেই অসংখ্য ছোট-বড় ঝর্ণা এবং ঝিরিপথ আছে। ঝরঝরি নামে একটি ছোট ঝর্ণা রাস্তাটির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নিচের দিকে গেছে। প্রচুর বাঁক আর কোথাও একেবারে খাড়া এই সড়কটি দর্শনার্থীদের দেয় শিহরণ জাগানো অনুভূতি। রাস্তার দু'পাশের দৃশ্যও মনোমুগ্ধকর।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি ও ফটিকছড়ির সন্তান রকিবুল আলম চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, পাহাড় ও সমতলের অপরূপ মেলবন্ধন ফটিকছড়িতে। মূলত সড়ক যোগাযোগ ও প্রচারের অভাবে এখানকার প্রাকৃতিক দর্শনীয় স্থানগুলো পর্যটকদের অগোচরেই ছিলো। স্থানীয় চা-বাগানগুলোতেও পর্যটনের দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে।'
চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপথ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, হাটহাজারী সদর থেকে ফটিকছড়ির হেয়াকো-মানিকছড়ি-মাটিরাঙা হয়ে খাগড়াছড়ি পর্যন্ত ৩২ দশমিক ৫০ কিলোমিটার সরু সড়কটি চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে ৩৯৯ কোটি টাকা ব্যয়ে।
স্থানীয়রা বলছেন, যোগাযোগের দুরবস্থার কারণে এক সময় পর্যটকরা খাগড়াছড়িতে আসতে চাইতো না। কিন্তু সাম্প্রতি হাটহাজারী থেকে খাগড়াছড়ি, বারৈয়ারহাট থেকে ফটিকছড়ি হয়ে খাগড়াছড়ি, মহালছড়ি-সিন্ধুকছড়ি-জালিয়াপাড়া সংযোগ সড়ক ও খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ হবার পর খাগড়াছড়িতে বেড়েছে পর্যটকের আনাগোনা।
মহালছড়ি-সিন্ধুকছড়ি-জালিয়াপাড়া সংযোগ সড়ক ব্যবহার করে ঢাকা থেকে রামগড় জালিয়াপাড়া হয়ে মহালছড়ির ২৪ মাইল এলাকা দিয়ে চালু হয়েছে রাঙামাটির সরাসরি সড়ক যোগাযোগ। মাত্র ২৪ কিলোমিটার এ সড়ক নির্মাণের ফলে ঢাকা-রাঙ্গামাটির সড়ক যোগাযোগ কমেছে ৭০ কিলোমিটার, সময়ও বাঁচছে প্রায় ৩ ঘণ্টা। সড়ক যোগাযোগ ছাড়াও রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর, খাগড়াছড়ির মহালছড়ি, গুইমারা ও লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার কৃষি অর্থনীতিতে গতি আনছে এ সড়ক। নয়নাভিরাম এ সড়কের ভৌগলিক অবস্থান দেখতে প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসছে পর্যটকও।
গুইমারা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান উশেপ্রু মারমা বলেন, "জালিয়াপাড়া থেকে মহালছড়ি সিন্দুকছড়ি সড়ক খাগড়াছড়ির দুই উপজেলার কৃষি অর্থনীতি ছাড়াও কাপ্তাই হ্রদবেষ্টিত রাঙামাটির মৎস্য খাত, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পর্যটনের আমূল পরিবর্তন এনে দিচ্ছে।"
এছাড়াও চট্টগ্রামের মইজ্জারটেক-বিএনডিসি মৎস বন্দর ফেরীঘাট সড়ক; লক্ষ্মীপুর-চর আলেকজান্ডার-সোনাপুর সড়ক; সোনাপুর (মান্নাননগর)-চরজব্বর-স্টিমারঘাট সড়ক; ভূঁঞারহাট-চেয়ারম্যানঘাট সড়ক; সোনাইমুড়ি-সেনবাগ-কল্যান্দী সড়ক; চাঁপাপুর-টমছমব্রিজ-বার্ড-কালিরবাজার-বরুড়া সড়ক; নিমসার-বরুড়া সড়ক; খাজুরিয়া-পয়েলগাছা-বরুড়া সড়ক ও লাকসাম (বিনয়ঘর)-বাইয়ারাবাজার-ওমরগঞ্জ-নাঙ্গলকোট সড়ক চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনার প্রতিশ্রুতি মেলে ধরে।