এনআইডি সংশোধন প্রক্রিয়া কেন এত যন্ত্রণাদায়ক দীর্ঘ?
সময়ের সঙ্গে জাতীয় পরিচয় পত্র (এনআইডি) কার্ড সংশোধন জটিল হচ্ছে। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মিথ্যা তথ্য দিয়ে যাতে এনআইডি পরিবর্তন করা না যায়, সেজন্যই সংশোধন প্রক্রিয়া জটিল করা হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
জাতীয় নির্বাচন কমিশনের এনআইডি শাখার পরিচালক মো. ইউনুস আলী বলেন, 'আসলে আগে এনআইডিতে তথ্য কম নেওয়া হত। কেউ আবেদন করলে, সহজে সংশোধন করা যেত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে আমরা সংশোধনে বিভিন্ন নতুন সমস্যা পাচ্ছি। আমরাও বুঝতে পেরেছি কোন কোন জায়গায় সতর্ক হওয়া দরকার। সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তথ্যও নেওয়া হচ্ছে অনেক বেশি'।
স্বচ্ছতা আনতে ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে এনআইডি পরিবর্তন বন্ধ করতে সংশোধন প্রক্রিয়া কিছুটা জটিল করা হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'তবে যদি দেখা যায় সার্ভারে তথ্য ঠিক আছে, কার্ডে ভুল প্রিন্ট হয়েছে, সেক্ষেত্রে আমরা সাথে সাথে ব্যবস্থা নিই'।
তিনি আরও বলেন 'অনেকেই নিয়মবহির্ভূতভাবে অনৈতিক সুবিধাভোগের উদ্দেশ্যে তথ্য পরিবর্তন করতে চায়। বিশেষ করে বিদেশগমনের জন্য এটা প্রচুর পরিমাণে হচ্ছে। আবার জাল বা টেম্পারিং করা সার্টিফিকেট দিয়েও সংশোধনের আবেদন পাচ্ছি। এছাড়া অনেকে নকল পাসপোর্ট, জাল কাবিননামা, জাল নিকাহনামা ইত্যাদি দিয়ে সংশোধনের আবেদন করেন। কখনও কখনও ব্যক্তি একাধিকবার সংশোধন করতে চান। অনেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে সনদ টেম্পারিং করে জন্মতারিখ পিছিয়ে সংশোধনের আবেদন করেন'।
'তাই আমরা সংশোধনের আবেদনের সকল তথ্য ভেরিফাই করি। একাডেমিক সার্টিফিকেট ভেরিফাই করতে, শিক্ষাবোর্ডকে চিঠি দেই। অনেক সময় তাদের সাড়া পাই না। এখানে একটা জটিলতা তৈরি হয়', জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'এছাড়া সন্দেহজনক সংশোধনের আবেদনে আমরা শুনানি করি। এতে আবেদনকারী সন্তোষজনক জবাব ও প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হলে, তদন্ত করে আমাদের সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হয়'।
'অনেকেই সত্য এড়িয়ে যেতে চায়। কিন্তু আমরা আইন ও বিধির আলোকে বিচার করে দেখতে চাই তার চাওয়া সঠিক কি না। সেক্ষেত্রে তদন্ত ও শুনানি করে সিদ্ধান্ত দিতে হয়। তাই বিষয়টা অনেকের কাছে কিছুটা জটিল বলেও মনে হচ্ছে,' বলেন তিনি।
পরিচালক আরও বলেন, 'আবার আমরা সংশোধনের ক্ষেত্রে আবেদনকারীর কাছে প্রমাণস্বরূপ বিভিন্ন তথ্য চাই, কিন্তু দেখা গেছে ৩০ দিন পার হলেও অনেকে সেই তথ্য দেয় না। ফলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংশোধন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না'।
'এদিকে ২০১৯ সাল থেকে আমরা আবেদনকারীর ডকুমেন্ট স্ক্যান করে সার্ভারে রাখি, এতে পরবর্তীকালে কোনো ভুল তথ্য দিয়ে সংশোধন করার সুযোগ কম থাকে। ফলে অনেকে এটা হয়রানি বলে চালাতে চান', অভিযোগ ইউনূস আলীর।
'তবে সবার যাতে জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়তে না হয়, তাই আমরা সংশোধন প্রক্রিয়াকে ক, খ, গ ও ঘ চার ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছি। ক্যাটাগরি অনুযায়ী সংশোধনটাও সহজ থেকে জটিল হয়। কোনো সমস্যা না থাকলে ৩০ দিনের মধ্যেই সংশোধন করে দেওয়া হয়'।
নতুন ভুল কমাতেও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে ইউনূস আলী বলেন, 'কয়েক ধাপে নতুন আবেদনের তথ্য যাচাই করা হয়। জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য আবেদনকারী নিজে ফর্ম পূরণ করেন। ডেটা এন্ট্রি অপারেটর সেই তথ্য সার্ভারে তুলেন। এরপর একজন প্রুফ রিডার সেটা যাচাই করে দেখেন। আবেদনকারী যখন ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ছবি দিতে আসেন, তখন আবার তাকে যাচাই করতে দেওয়া হয়। যাচাই শেষে সেই কপিতেও তিনি সই করেন। এসব নিয়মের কারণে ভুলের সংখ্যা এখন নেই বললেই চলে'।
তবে শুরুর দিকে তেমন কেউ সংশোধনের জন্য আসত না বলে জানান সাবেক একজন নির্বাচন কমিশনার।
'২০০৮ সালে তাড়াহুড়া করে ভোটার কার্ড করা হয়। মাত্র দেড় বছরে ৮ কোটি কার্ড করা হয়। ফলে অনেক ভুল থেকে যায়। তবে যেহেতু শুধুমাত্র ভোটার কার্ড হিসেবে তখন নিবন্ধন করা হচ্ছিল, মানুষের এটা নিয়ে তেমন চিন্তা ছিল না। এজন্য ভুল থাকলেও কেউ সংশোধন করতে আসার তেমন একটা প্রয়োজন অনুভব করত না, বলেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন।
তিনি জানান, 'এর গুরুত্ব বাড়তে শুরু করে ২০১২ সালের দিকে বিশ্ব ব্যাংক কর্তৃক ন্যাশনাল আইডি কার্ডের ওপর একটি প্রজেক্ট নিয়ে আসার পরে। প্রজেক্টে এনআইডি-র সাথে নানা সুযোগ-সুবিধা ও সার্ভিস যুক্ত করা হয়। এতে মানুষ ভুল সংশোধনে হুমড়ি খেয়ে পরে, যা পরে জটিল আকার ধারণ করে'।
মানুষ যাতে অহেতুক হয়রানির শিকার না হয় ও জটিলতার মধ্যে না পরে সেজন্য এনআইডি সংশোধনের সেবা থানা পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়েছে বলে জানান এনআইডি উইংয়ের মহাপরিচালক একেএম হুমায়ুন কবির।
তিনি বলেন, 'জটিলতার বিষয় বিবেচনা করেই সংশোধন-প্রক্রিয়াকে বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে। এখন নিজ থানায় এনআইডি সংশোধনের অনেক সেবা পাওয়া যায়। এছাড়া যাদের সংশোধন কম ও স্বপক্ষে প্রমাণ করার কোনো ঝামেলা নাই, তাদের নির্ধারিত সময়ের (৩০দিন) মধ্যেই সংশোধন করে দেওয়া হয়'।