‘পলিসি সাপোর্ট পেলে ৩০০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সেভ করতে পারবে আকিজ বায়াক্স ফিল্মস’
খাদ্যদ্রব্য, গার্মেন্টস সামগ্রী, বেভারেজ, ওষুধ, টোব্যাকোসহ নানা পণ্যের প্যাকেজিং ও লেভেলিংয়ে ব্যবহৃত ফেক্সিবল ফিল্মের মার্কেট ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। দেশের ইন্ডাস্ট্রিগুলোর কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত প্যাকেজিং ফিল্মসের জন্য দেশে প্রথমবারের মতো প্লান্ট স্থাপন করেছে আকিজ গ্রুপ। প্রায় ১০০০ কোটি টাকার বড় বিনিয়োগে আকিজ বায়াক্স ফিল্মস নামে পণ্য উৎপাদন শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বায়াক্স ফিল্মে আকিজ গ্রুপের বিপুল বিনিয়োগ, দেশে এ পণ্যের বাজার এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে সম্প্রতি দ্যা বিজনেস স্টান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস কে বশির উদ্দিন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের নির্বাহী সম্পাদক শাহরিয়ার খান।
আকিজ বায়াক্স ফিল্মস লিমিটেড (এবিএফএল) আপনাদের একটি নতুন ভেঞ্চার। এই প্রডাক্ট লাইন সম্পর্কে জানতে চাই…
বিস্কুট, চানাচুর, গুড়ো দুধ, গার্মেন্টসহ যেকোনো পণ্যের প্যাকেজিংয়ে এ পণ্যটি দরকার হয়। লোকাল প্যাকেজিং কোম্পানি কাঁচামাল হিসাবে এটি ব্যবহার করে।
দেশে প্রতিবছর ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ফিল্মের দরকার হলেও আকিজ ছাড়া কেউ বিনিয়োগ করেনি। গড়ে উঠেনি কোনো লোকাল ইন্ডাস্ট্রি। আমরা বর্তমানে প্যাকেজিংয়ে ব্যবহৃত বায়াক্সালি-ওরিয়েন্টেড পলিপ্রোপিলিন (বিওপিপি), বায়াক্সালি-ওরিয়েন্টেড পলিইথিলিন টেরেফথালেট (বিওপিইটি) এবং কাস্ট পলিপ্রোপিলিন (সিপিপি) তিন ধরনের পণ্যই উৎপাদন করছি।
আকিজ কেন এ ইন্ডাস্ট্রিতে বিনিয়োগ করেছে?
বাংলাদেশে বায়াক্স ফিল্মের ব্যবহার শুরু ১৯৮০ থেকে। প্রথমদিকে পাউডার মিল্কের প্যাকেটে ব্যবহারের জন্য সম্পূর্ণরুপে প্রিন্টেড অবস্থায় আমদানি হতো। আশির দশকের পর কাঁচামাল আমদানি করে প্রিন্ট বসানোর মাধ্যমে ফেক্সিবল ইন্ডাস্ট্রির যাত্রা শুরু হয়।
ধীরে ধীরে এ চাহিদা বেড়ে বর্তমানে বছরে ৮০-৯০ হাজার টন ফেক্সিবল ফয়েল মেটারিয়ালসের বাজার তৈরি হয়েছে। কিন্তু এটি শতভাগ আমদানি নির্ভর হওয়ায় বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে।
এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে আমরা ২০১০ সালে বিনিয়োগের চিন্তা করি। এরপর এ পণ্যের সাপ্লায়ার এবং মার্কেটে প্রয়োজনীয়তা নিয়ে স্টাডি করি। এটি প্লাস্টিক পণ্য হওয়ায় পরিবেশ ক্ষতির বিষয়টিও দেখতে হয়েছে। ফলে আমাদের অনেক বেশি বিনিয়োগ করতে হয় এবং অনেক সময়ও লেগে যায়।
সর্বশেষ আমরা এমন একটা প্রযুক্তি নিয়ে এসেছি যা মনোম্যাটারিয়াল নামে পরিচিত। সার্কুলার ইকোনমির মতো একই পণ্য ব্যবহার করে নষ্ট হওয়ার পর আবার আবার নতুন পণ্যে রূপ নেবে। আমাদের ফিল্মটা গ্রাহকরা ব্যবহার করার পর সেটাকে আমরা আবার কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করে নতুন পণ্য উৎপাদন করছি।
বিদেশি পণ্য থেকে বাংলাদেশি পণ্য, গ্রাহকরা কিভাবে গ্রহণ করেছে?
পণ্যটি নিয়ে মার্কেটে যাওয়ার পর প্রত্যেকে আমাদের দারুণভাবে গ্রহণ করেছে। আমদানিকৃত পণ্যকে রেখে সহজেই এটিকে গ্রহণ করেছে বায়ারা। ভালো মান এবং এফরডেবল দাম হলে দেশি পণ্য সহজেই বিদেশি পণ্যকে রিপ্লেস করতে পারে, আমরা তার উদাহরণ। তবে বিক্রি করতে গিয়ে বন্ডেড প্রোডাক্টের কাছে কিছুটা হোঁচট খেতে হয়েছে আমাদের।
বন্ডেড প্রোডাক্ট আপনাদের কিভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে?
বন্ডের ইমপোর্ট শতভাগ শুল্ক-মুক্ত। কারখানার মালিকরা ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ হিসাবে ভ্যাট, এআইটি, এটি, কাস্টমস ডিউটিসহ কোনো ধরনের ট্যাক্স ছাড়াই এটি আমদানি করতে পারেন। অন্যদিকে আমরা শুল্ক দিয়ে কাঁচামাল আমদানি করি। এটি আমাদেরকে আনহেলদি প্রতিযোগীতায় ফেলে দেয়। অনেক কোয়ালিটি সম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করেও আমাদের হোঁচট খেতে হচ্ছে।
আরেকটি সমস্যা হলো- ফেক্সিবল ফয়েলের কাঁচামাল আমদানিতে আমাদের ৫ শতাংশ শুল্ক-কর গুণতে হয়। অন্যদিকে প্যাকেজিং ম্যাটারিয়ালস হিসাবে এই পণ্যটি আমদানি করতে ব্যবসায়ীদের শুল্ক-কর দিতে হয় ১০ শতাংশ। দেশে বিপুল বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে ট্যাক্সের এ সামান্য ব্যবধান গ্রহণযোগ্য নয়। স্থানীয় শিল্প বিকাশে করের সুবিধা আরো বাড়ানো দরকার।
দেশে বর্তমান চাহিদার কতটুকু বন্ডেড পণ্যের দখলে?
দেশে বর্তমানে ৩ হাজার কোটি টাকার বাজারে বন্ডেড পণ্যই ৮০ শতাংশের বেশি। এটি ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহার হলেও তা থেকে সরকার কোনো রাজস্ব পায় না। অন্যদিকে ট্যাক্স দিয়ে আনহেলদি কম্পিটেশনের কারণে হুমকিতে আমাদের বিপুল বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান।
এ বিষয়টি নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন?
আমি ব্যক্তিগতভাবে বন্ড কমিশনারেটের সঙ্গে কয়েকবার বৈঠক করেছি। তাদেরকে জানিয়েছি। কিন্তু দৃশ্যমান কিছু হচ্ছে না।
ফেক্সিবল ফয়েলের বন্ড সুবিধা বন্ধ করে দিলে মার্কেটের চাহিদা পূরণের সক্ষমতা আকিজের রয়েছে কি?
আমাদের বর্তমান ক্যাপাসিটি ৯০ হাজার টনের। দেশের মার্কেটে ডিমান্ডই এর চেয়ে কম। ফলে আমরা ক্যাপাসিটির খুব সামান্যই ব্যবহার করছি। বর্তমানে লোকাল মার্কেটের ২০ শতাংশ দখলে নিতে পেরেছি। অন্যদিকে আমাদের উৎপাদিত পণ্যের ৪০ শতাংশ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
আমরা জার্মানি, পোল্যান্ড, ফ্র্যান্স, ভারতসহ এখন পর্যন্ত ২০টি দেশে রপ্তানি করছি। আকিজ ছাড়াও আরো একটি কোম্পানি এ ইন্ডাস্ট্রিতে বিনিয়োগ করেছে। ফলে আমরা স্থানীয়ভাবেই চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম।
কাঁচামাল আমদানি করে বায়োফিক্স উৎপাদনে আকিজ কতটুকু ভ্যালু এড করে?
আমাদের ফিল্মটাতে দুই ভাগে ভ্যালু এডিশন হয়। উৎপাদনের দুটি প্রক্রিয়া মিলে ৬০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত ভ্যালু এডিশন হয়। ভ্যালু এডিশনের চেয়ে বড় বিষয় হলো, লোকাল ম্যানুফ্যাকচাররা তাদের ডিমান্ড অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাপের পণ্য অর্ডার দিয়ে বানাতে পারেন।
এলসি ওপেন করে দিনের পর দিন অপেক্ষা না করে নির্দিষ্ট সময়ে কাঁচামাল পেয়ে যান। একই সঙ্গে এর মাধ্যমে বছরে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার বিদেশি মুদ্রা সেইভ করা সম্ভব।
বন্ডের পণ্যের কারণে সরকার কেমন রাজস্ব হারাচ্ছে? এই সুবিধা না থাকলে ফিল্মটার প্রাইস কতটুকু কম্পেটিটিভ হবে?
মার্কেটের খুব অল্প শেয়ার নিয়ে আকিজ ফায়োফিক্স বছরে ১০০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব দিচ্ছে। ফলে বন্ডেড ব্যবস্থার কারণে সরকার এখান থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে এটা বলাই যায়।
বন্ডেড সুবিধা না থাকলেও প্রাইস অবশ্যই কম্পিটেটিভিই হবে। লোকাল ক্রেতারা সবাই আন্তর্জাতিক বাজারে এ পণ্যের দাম জানেন। তারা ওই দামের ওপর ভিত্তি করেই আমাদের সঙ্গে নেগোশিয়েশন করেন।
আমরা এমন প্রোটেকশন চাই না, যা ভোক্তাকে হার্ট করবে, অন্য একটা প্রতিষ্ঠানকে হার্ট করবে। আমরা গ্লোবাল প্রাইসটা চাই। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্য মানুষ সহজে পাবে এবং ন্যায্যমূল্যে পাবে। এটাই লোকাল ইন্ডাস্ট্রির চাওয়া।