চিনি তেতো হয়ে উঠছে!
বিশ্ববাজারে বাড়তি দাম, চলমান ডলার সংকটে এলসি খোলায় সমস্যা এবং আমদানিতে উচ্চ করের কারণে স্থানীয় বাজারে চিনির সরবরাহ সংকট তৈরি হয়েছে। ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই পরিস্থিতি আসন্ন রমজান মাসে আরও বাজে রূপ নিতে পারে।
এরমধ্যেই বৃহস্পতিবার (২৬ জানুয়ারি) দেশের চিনি পরিশোধনকারীদের সংগঠন – বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন – চিনির দাম কেজিতে ৫ টাকা বাড়িয়েছে। ফলে পরিশোধিত খোলা চিনির দাম পড়বে কেজিতে ১০৭ টাকা। আর পরিশোধিত প্যাকেটজাত চিনির দাম পড়বে কেজিতে ১১২ টাকা করে।
আগামী ১ ফেব্রুয়ারি থেকে নতুন দাম কার্যকর হবে।
সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনার পর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এনিয়ে গত ছয় মাসের মধ্যে তৃতীয়বার চিনির দাম বাড়াল সরকার। তবে অধিকাংশক্ষেত্রেই ব্যবসায়ীরা সরকার নির্ধারিত দাম মানছেন না, এবং তার চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করছেন।
এর আগে ২০২২ সালের ১৭ নভেম্বরে পরিশোধিত চিনির দাম ১৩ টাকা বাড়িয়ে খোলা চিনির ক্ষেত্রে কেজিতে ১০২ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনির ক্ষেত্রে ১০৭ টাকা করা হয়।
তবে বাজারে প্যাকেটজাত ও খোলা চিনি বর্তমানে ১২৫-১৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি, যা বৃহস্পতিবার নির্ধারিত দামেও চেয়েও অনেকটাই বেশি।
রাজধানীর সেগুনবাগিচার একটি জেনারেল স্টোরের মালিক মো. শাহিদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, 'বেশি দামে কিনতে হয় বলেই, আমাদের প্রতিকেজি চিনি ১২৫ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে'।
এদিকে পাইকারী ব্যবসায়ীদের মতে, মিলগুলো থেকে চিনির সরবরাহ পেতে অন্তত ১৫-২০ দিন সময় লাগছে। যে কারণে সরবরাহও কমছে। আমদানি কমায় এবং চিনির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায়– আসন্ন রমজানে বাজারে পণ্যটির সরবরাহে সংকট ঘনিয়ে আসছে।
সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন- এর মহাসচিব গোলাম রহমান টিবিএসকে বলেন, 'এলসির জন্য আমরা এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে ঘুরছি, কিন্তু সেটা করতে পারছি না। এই সমস্যা বেশ কয়েক মাস ধরেই হচ্ছে। আমদানির পরিস্থিতি পরিবর্তন নাহলে সরবরাহ বাড়বে না'।
তিনি বলেন, 'সরকার শুধু রিফাইনারদের জন্য দামটা ঠিক করে দিচ্ছে। কিন্তু পাইকারী বিক্রেতারা বাজারে কত টাকায় বিক্রি করবে, সেটা ঠিক করে নাই। ফলে বাজারে যে বাড়তি দাম- সেটার দায় কিন্তু আমাদের না, সেটা সরকারকেই দেখতে হবে।'
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা ১৮-২০ লাখ টন, সে তুলনায় স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয় মাত্র ৩০ হাজার টন।
মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলোর মতে, ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বরে চিনি আমদানি কমেছে প্রায় ২.০৮ লাখ টন।
সে তুলনায়, চিনির মাসিক চাহিদা প্রায় দেড় লাখ টন, রমজানে যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়। দেশের চিনি চাহিদার ৫০ শতাংশ দরকার হয় প্রক্রিয়াজাত খাদ্যশিল্পে। একারণেই এ শিল্পে উৎপাদন খরচও বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশের ব্রেড, বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, ময়দা ও চিনির তো বিভিন্ন কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ ৫ টাকা থেকে তিনগুণ বেড়ে ১৫ টাকা হয়ে গেছে। এই শিল্পে ব্যবহৃত ৭০ শতাংশ চিনিই দরকার হয়ে বেকারি ও বিস্কুট উৎপাদনে'।
বৃহস্পতিবার বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গণমাধ্যমকে বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম বেড়েছে। বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দাম ঠিক না করলে দেশের বাজারে অস্থিরতা কমবে না'।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি চারটি ব্যাংককে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিত্যপণ্য আমদানির এলসি খুলতে নির্দেশনা দিয়েছে।
চিনির দাম বৃদ্ধির পেছনে আরেকটি কারণ হলো- উচ্চ আমদানি শুল্ক। বর্তমানে অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে বিভিন্ন ধরনের মোট ৬১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা রয়েছে। ডলারের দাম ও বিশ্ববাজারে চিনির দাম বৃদ্ধির কারণে শুল্কের পরিমাণও বেড়েছে। ফলে প্রতিটন চিনিতে আমদানি শুল্ক দিতে হচ্ছে ৩১-৩২ হাজার টাকা, যা আগে ছিল ২২-২৩ হাজার টাকা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বারবার সুপারিশ করার পরও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চিনি আমদানিতে শুল্ক কমানোর এখনও কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
বৈশ্বিক উৎপাদনের অবস্থা ভালো থাকলেও বাংলাদেশ ব্রাজিলের পর সবচেয়ে বেশি চিনি আমদানি করে ভারত থেকে। কিন্তু, ভারত থেকে বর্তমানে চিনি আমদানি বন্ধ রয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানান, ব্রাজিল থেকে চিনি আমদানি করে বাজারজাত পর্যন্ত ৪৫-৬০ দিন পর্যন্ত সময় লাগে।
চিনির স্থানীয় উৎপাদন বাজারে প্রভাব ফেলে না
দেশের ছয়টি চিনিকল বন্ধ হওয়ার কারণে স্থানীয় উৎপাদন একেবারেই তলানিতে নেমেছে। এই উৎপাদন এখন ৩০ হাজার টনের নিচে নেমেছে, যা ২০১৩-১৪ অর্থবছরেও ছিল ১.২৮ লাখ টন।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানান, চিনির বাজার পুরোপুরিই আমদানি নির্ভর, স্থানীয় উৎপাদন এতটা কম যে এটা বাজারে কোনো প্রভাবই বিস্তার করতে পারে না।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের (বিএসএফআইসি) তথ্যমতে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ১.২৮ লাখ টন চিনি উৎপাদন হয়। ওই সময় ১৫টি চিনিকল উৎপাদনে ছিল।
এরপর কমতে কমতে ২০২১-২২ অর্থবছরে সবচেয়ে কম ২৪ হাজার মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন হয়। এখন চিনি উৎপাদনে রয়েছে ৯টি সরকারি চিনিকল। বড় লোকসানের কারণে ২০২০ সালে সরকার ৬টি চিনিকলে উৎপাদন বন্ধ করে।
নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস- এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনিসুল আজম টিবিএসকে বলেন, 'আখ মাড়াই থেকে চিনি উৎপাদনে এখন প্রতি কেজিতে খরচ পড়ে ১৫০ টাকা। তবে মিলের যে ঋণ রয়েছে, তা হিসাব করলে প্রতি কেজিতে উৎপাদন খরচ হবে প্রায় তিনশ টাকা'।