তেজগাঁওয়ে বেড়েছে ছিনতাই, ওয়ারিতে খুন
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অপরাধ বিষয়ক তথ্য অনুযায়ী, গত বছর রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে তেজগাঁওয়ে। তালিকায় এরপরই রয়েছে উত্তরা ও মিরপুর।
২০২২ সালে ডিএমপির তেজগাঁও ক্রাইম বিভাগের বিভিন্ন থানায় প্রায় ৩৩টি ছিনতাইয়ের মামলা করা হয়েছে। উত্তরা থানায় ছিনতাইয়ের মামলা করা হয়েছে ২৮টি, মিরপুরে মামলা হয়েছে ১৪টি।
গত বছর নগরীর ৫০টি থানায় মোট ১০৩টি ছিনতাইয়ের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে।
ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ছিনতাইয়ের ঘটনা আগের বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২১ এ ছিনতাইয়ের মামলা রেকর্ড করা হয় ৬২টি।
নগরীতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের প্রবণতা বৃদ্ধির বিষয়ে পুলিশও অবগত।
২৯ জানুয়ারি ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, ছিনতাইকারীদের বিস্তারের কারণে মধ্যরাতের পর যাত্রীদের জন্য নিরাপদ নয় রাজধানী ঢাকা।
এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে তিনি নগরবাসী ও যাত্রীদের মধ্যরাতের পর রাস্তায় চলাচল না করতে বলেন।
সম্প্রতি ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া রুনু আক্তার তার তিক্ত ও ভীতিকর অভিজ্ঞতা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাথে শেয়ার করেছেন।
"১৪ জানুয়ারি রাত ৯টার দিকে আমি রিকশায় করে ফার্মগেট থেকে আগারগাঁও তালতলা যাচ্ছিলাম। সবকিছু এত দ্রুত ঘটে গেলো…"
"আমার সাথে আমার ছেলে ছিল। আমাদের রিকশা মিরপুর রোডের আগারগাঁও মোড়ে পৌঁছালে কোথা থেকে এসে যেন একটা প্রাইভেট কার আমাদের পথ বন্ধ করে দেয়," বলছিলেন রুনু আক্তার।
"কী ঘটছে বুঝতে পারার আগেই গাড়ি থেকে কেউ এসে আমার ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়," তার সেই ব্যাগে নগদ ৬০ হাজার টাকা, পরিবারের সদস্যদের ৬টি পাসপোর্টসহ অন্যান্য মূল্যবান জিনিস ছিল।
রুনু আক্তার বলেন, "আমি যখন শেরেবাংলা নগর থানায় অভিযোগ করতে যাই, তখন পুলিশ ছিনতাইয়ের মামলা না করে আমাকে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে বলে।" জিডি করার এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও পুলিশের পক্ষ থেকে তার সাথে আর যোগাযোগ করা হয়নি।
একই রকম ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মহিউদ্দিন সম্রাটের সঙ্গে। শিশুমেলা-আগারগাঁও সড়কে জাতীয় চক্ষু ইনস্টিটিউটের সামনে সাদা রঙের একটি গাড়িতে করে এসে তাকে ছিনতাই করা হয়।
এছাড়া, মোহাম্মদপুরও ছিনতাইয়ের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে।
সম্প্রতি মোহাম্মদপুর থানা পরিদর্শন করে টিবিএস দেখেছে, অন্তত চার থেকে পাঁচজন লোক বেড়িবাঁধ ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় তাদের সাথে ঘটা ছিনতাইয়ের অভিযোগ জানাতে এসেছে।
থানায় মামলা করতে আসা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী টিবিএসকে বলেন, ঢাকা উদ্যান রোডে ছিনতাইয়ের প্রবণতা বেশি।
কেন ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়ছে জানতে চাইলে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মোহাম্মদপুর জোন) মৃত্যুঞ্জয় দে সজল বলেন, এরা বেশিরভাগই দারিদ্র্যপীড়িত এবং নিম্ন আয়ের পরিবারের লোকজন, এবং এরমধ্যে বেশিরভাগই ভাসমান লোকজন, স্থানীয় নন।
মোহাম্মদপুর, বেড়িবাঁধ ও বসিলা এলাকায় প্রতিদিনই কাজ বা অন্যকোনো প্রয়োজনে প্রচুর মানুষ যাতায়াত করে। তাদের অনেকেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত। পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, এই এলাকায় ব্যাপক ছিনতাইয়ের এটি একটি প্রধান কারণ। এসব লোকের ট্র্যাক রাখা কঠিন।
রাজধানী জুড়ে ছিনতাই, চুরি, চাঁদাবাজি এবং অন্যান্য অপরাধের সাথে জড়িত থাকায় ২৮ জানুয়ারি র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন 'ব্রেভ ডেঞ্জার স্ট্রং কিং' নামে একটি আদাবর-ভিত্তিক গ্যাংয়ের ৮ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।
এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, টানা নয় মাস (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) মোহাম্মদপুর জোনে অপরাধ দমনে সাহসী প্রচেষ্টার জন্য গত বছর সেরা সহকারী কমিশনার হিসেবে স্বীকৃতি পান ডিএমপির তৎকালীন সহকারী কমিশনার (মোহাম্মদপুর জোন) মুজিব পাটোয়ারী। মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানার সমন্বয়ে গঠিত মোহাম্মদপুর জোন।
কিন্তু ক্রমশই বাড়তে থাকা অপরাধের মাত্রা আদতে ভিন্ন চিত্রই দেখাচ্ছে। এ বিষয়ে মুজিব পাটোয়ারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এছাড়া মোহাম্মদপুর, আগারগাঁও, তেজগাঁও বাসস্ট্যান্ড, কারওয়ানবাজার ও আসাদ এভিনিউও ছিনতাইয়ের হটস্পট হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছে ডিএমপির অপরাধ বিভাগ।
গত বছর সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে ওয়ারীতে
২০২২ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় প্রায় ১৭৩ জনকে হত্যা করা হয়। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক খুনের ঘটনা ঘটেছে ওয়ারী অপরাধ বিভাগেই। এ বিভাগে ৩৬টি খুনের ঘটনা ঘটে।
এর কারণ জানতে চাইলে ওয়ারী বিভাগের উপ-কমিশনার জিয়াউল হক তালুকদারও ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের (মোহাম্মদপুর জোন) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মৃত্যুঞ্জয় দে সজলের মতোই উত্তর দিয়েছেন।
"ওয়ারীর কদমতলী ও শ্যামপুর এলাকায় বসবাসকারী অনেক দরিদ্র, বেকার ও মাদকাসক্ত যুবক ডাকাতিসহ অন্যান্য ছোটখাটো অপরাধের সাথে জড়িত। তাদের মধ্যে কেউ কেউ খুনের সঙ্গেও জড়িত," বলেন তিনি।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি এবং পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ওমর ফারুক টিবিএসকে বলেন, ডেটা এবং কেস রেকর্ড বিশ্লেষণ করলে সহজেই ছিনতাই প্রতিরোধ করা যায়।
তিনি বলেন, "ছিনতাইয়ের ঘটনা কমাতে রাস্তায় টহল দেওয়ার ক্ষেত্রে রাতের বেলা পুলিশকে আরো সতর্ক হতে হবে।"
"পুলিশ শুধু একদল লোককে দোষারোপ করে দায় এড়াতে পারে না। পুলিশ চাইলে কোনো এলাকায় প্রবেশ করা বা এলাকা থেকে বাইরে যাওয়া লোকজনের ওপর নজরদারি করতে পারে। এই নজরদারি তাদের কর্তব্য, এর মাধ্যমে যতটা সম্ভব অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করাও তাদের কর্তব্য," যোগ করেন এই অধ্যাপক।