দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা নিয়ে যেভাবে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনলেন ভাস্কর
আধুনিক সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী বিজ্ঞানীদের একজন স্টিফেন হকিং একবার বলেছিলেন, "সাফল্যের পথে অক্ষমতা কোনো বাধা হতে পারে না।" বিরল রোগে আক্রান্ত হয়ে হুইলচেয়ারে বসে কাটানো এ পদার্থবিদ নিজেই এ উক্তির সত্যতা প্রমাণ করেছিলেন; আর তার অনুসরণ করেছেন আরও অনেকে।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতার শিকার ভাস্কর ভট্টাচার্যও তাদের একজন, যারা হকিংয়ের পথে হেঁটেছেন।
বড় হওয়ার সময়ে দেখেছেন, তার থেকে সমাজের কোনো প্রত্যাশা নেই; সমাজের ধারণা তাকে দিয়ে কিছু হবে না। আজ সেই সমাজকেই ভুল প্রমাণিত করেছেন ভাস্কর।
ভাস্কর ভট্টাচার্য এখন সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের এটুআইয়ের অ্যাক্সেসিবিলিটি প্রগ্রামের জাতীয় পরামর্শক হিসেবে কর্মরত। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে ভাস্কর এখন তার আশেপাশের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষদের জীবন সহজ করার জন্যে কাজ করছেন।
চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট ইউনিয়নের বাগদণ্ডী গ্রামে ভাস্করের জন্ম। বয়স যখন দুই তখনই তার চোখে না দেখার বিষয়টি বুঝতে পারেন বাবা-মা। তখনো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের স্কুলে যাওয়ার কথা শোনা যায়নি, ভাস্করের বাবা-মা তাই সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন।
পরে তাকে একটি বিশেষ স্কুলে ভর্তি করান তার বাবা। সেখান থেকে প্রাইমারী স্কুলের গন্ডি পেরোলেও চট্টগ্রামের কোন হাইস্কুলে ভর্তি হতে পারেননি তিনি। প্রাইভেটে এসএসসি পরীক্ষা দিতে হয়। সমস্যা হয়েছিলো ভালো কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে। যদিও পরে চট্টগ্রাম সিটি কলেজে ভর্তি হন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে ডিসিপ্লিন হিসেবে বেছে নেন আর্টসকে। ভাস্কর অধ্যবসায়ী ছিলেন, ব্রেইল বইয়ের সহায়তায় শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন ভাস্কর।
ভাস্কর ভট্টাচার্য বলেন, "চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য আমাকে সংগ্রাম করতে হয়েছিলো। সে বিশ্ববিদ্যালয়কে এখন দেশের একটি ইনক্লুসিভ ইউনিভার্সিটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে এখন ১৫০ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী পড়াশুনা করছে। সেখানে কোটা আছে, বৃত্তি দেয়া হয়, ই-লার্নিং সেন্টার আমরা তৈরি করেছি, অ্যাক্সেসিবল রিডিং ম্যাটেরিয়ালস দেয়া হয়েছে, ছেলেমেয়েদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটি অন্যদের কাছে মডেল হিসেবে পরিচিত হচ্ছে।"
পাশাপাশি ভাস্কর জাপান থেকে ডাসকিন লিডারশিপের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছেন; ভূষিত হয়েছেন অ্যাকুমেন ফেলোশিপ, অ্যাপনিক ফেলোশিপ, ইন্টারনেট সোসাইটি আইজিএফ অ্যাম্বাসেডর এবং আরও অনেক সম্মাননায়।
নিজের লেখাপড়া নিয়ে আক্ষেপ থাকায় ভাস্কর দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পড়াশোনার বিষয়টিতে নজর দিয়েছেন। প্রথম থেকে দশম শ্রেণির সব বই ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া (পুরো টেক্সট, পুরো অডিওসহ) বইয়ে রূপান্তরিত করেছেন। এ বইগুলো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা পড়তে পারছেন। সহজে ব্রেইল করতে পারছেন।
একসময় ভাস্করের স্বপ্নের বিস্তার অনেক ছোট ছিলো। কোনো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুলে শিক্ষক হতে পারবেন কিনা শুধুই সে স্বপ্ন ছিলো। ভাস্করের জীবন বদলে যায় ২০০২ সালে জাপানে পড়তে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে।
ভাস্কর বলেন, "এডুকেশনাল সাপোর্টে জাপানে এক বছরের প্রশিক্ষণ শেষ করলাম। সেখানে প্রথম আমি কম্পিউটার ধরলাম, প্রথম স্মার্টফোনের ব্যবহারও তখনই। প্রথম অ্যাক্সেসিবিলিটির গুরুত্ব বুঝতে পারলাম। প্রথমবারের মতো বুঝতে পারলাম প্রতিবন্ধিতা কোন বাধা নয়। আমার জীবনের স্বপ্নও যে কতটা বড় হওয়া উচিৎ, তাও তখন বুঝতে পারলাম।"
তবে জাপান থেকে ফেরার পর এক বছর বেকার বসে ছিলেন ভাস্কর। কেউ বিশ্বাস করতে পারতোনা যে, চোখে দেখতে পায় না এমন কেউও কিছু করতে পারে।
তারপর চট্টগ্রামের ওয়াইপিএসএ (ইয়াং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন) তাকে সুযোগ দেয়। মাঠে গিয়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা, প্রতিবন্ধী মানুষদের সংগঠন তৈরি করে ভাস্কর। এসব করতে করতে এটুআইয়ের সাথে যুক্ত হন ভাস্কর। ২০০৯ সালে যখন এটুআই শুরু হয় তখন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে এবং পরবর্তীতে উদ্ভাবক হিসেবে যুক্ত থাকেন ভাস্কর। ২০১৩ সাল থেকে এটুআইয়ের পেশাদার কর্মী ভাস্কর।
ভাস্কর বলেন, "প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি একটি বড় চ্যালেঞ্জ, কিন্তু সেই লক্ষ্যে কাজ চলছে। আমরা কিছু উদ্যোক্তা তৈরির জন্য কাজ করছি, ই-লার্নিংয়ের প্রচার করছি।"
অর্জন আর সম্মাননা
ভাস্কর ভট্টাচার্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষমতায়নে তাদের জন্য একটি উদ্ভাবনে সক্ষম পরিবেশ সৃষ্টিতে নিরলস কাজ করে চলেছেন।
তার বর্তমান লক্ষ্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বিশ্ববিদ্যালয় (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) বাস্তবায়নের। পাশাপাশি তিনি টেকসই উন্নয়নে ডিজঅ্যাবিলিটি পোর্টফোলিওতে পরামর্শমূলক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে একটি সংস্থার সাথে জড়িত।
ভাস্কর হলেন জিথ্রি-আইসিটি'র কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ এবং ডেইজি (ডিজিটাল অ্যাকসেসিবল ইনফরমেশন সিস্টেম), ডব্লিউআইপিও'র অ্যাকসেসিবল বুকস কনসোর্টিয়াম (এবিসি), বুকশেয়ার এবং সীতাকুণ্ডের ফেডারেশন অফ ডিপিও'র ফোকাল পারসন।
তিনি ইন্টারনেট সোসাইটি অ্যাক্সেসিবিলিটি স্ট্যান্ডিং গ্রুপের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও কাজ করেছেন।
ভাস্কর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য নতুন নতুন প্রযু্ক্তি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। যার মধ্যে রয়েছে ১ম থেকে ১০ম শ্রেণির সকল পাঠ্যপুস্তককে ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া টকিং বইয়ে পরিণত করা, অ্যাকসেসিবল ডিকশনারি তৈরি করা ইত্যাদি। এছাড়াও বাংলাদেশ সরকারের প্রায় ৩৩ হাজার ওয়েবসাইট যেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ব্যবহারোপযোগী হয়, সেজন্য এটুআইয়ের সাথে বিশেষজ্ঞ পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন ভাস্কর।
মাল্টিমিডিয়া টকিংবিুক সম্পর্কে ভাস্কর বলেন, "আমি জীবনে কখনো অ্যাকসেসিবল বই পাইনি। এই সমস্যার সমাধান আমাকে করতে হবে। আমার বড় মেয়ে যখন ক্লাস ওয়ানে পড়ে তখন নতুন বই নিয়ে আমার কাছে বারবার এসে বলতো, বাবা পড়ে দাও। আমি দেখতে পারিনা তাই পড়তে পারতাম না। তখন মনে হলো এমন কিছু কি উদ্ভাবন করতে পারি যার মাধ্যমে আমি পড়তে পারি এবং আমার মেয়ে শুনতে ও দেখতে পারে। এ ধারণা থেকে মাল্টিমিডিয়া টকিং বুক তৈরি করলাম। এটুআইয়ের সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ড আমাকে অ্যাওয়ার্ড দিলো। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী সেটি উদ্বোধন করলেন। এখন শুধু আমি না, প্রতিবন্ধী সব মা-বাবা তার সন্তানকে পড়াতে পারেন।"
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ইতিমধ্যে ভাস্কর দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গণে পুরস্কার অর্জন করেছেন। ২০১৬ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে একজন সফল প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে সম্মাননা প্রদান করেন। তার অন্যান্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- জিরো প্রজেক্ট এ্যাওয়ার্ড ২০১৬, যা তিনি অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা থেকে গ্রহণ করছেন; ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকসেসিবল পাবলিশিং এ্যাওয়ার্ড যা তিনি ২০১৪ সালে লন্ডন বুক ফেয়ার থেকে গ্রহণ করেন; আইএসআইএফ এশিয়া এ্যাওয়ার্ড যা তিনি তুরস্কের ইস্তাম্বুল ইন্টারন্যাশনাল গর্ভনেন্স থেকে ২০১৩ সালে গ্রহণ করেন এবং মাইক্রোসফট ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ইয়ুথ এ্যাওয়ার্ড কলম্বো থেকে ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ড উদ্ভাবনী এ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয় তাকে। এছাড়াও ২০১৭ সালে আমেরিকার নিউইয়র্ক থেকে তিনি হেনরি ভাস্কারদি এ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করেন।
তার উদ্ভাবিত মাল্টিমিডিয়া টকিং বুকের জন্য ডব্লিউএসআইএস পুরস্কার পায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের এটুআই প্রোগ্রাম। এই সকল উদ্ভাবনী কাজের জন্য তিনি ২০১৮ সালে ইউনেস্কো পুরস্কারপ্রাপ্ত হন।
শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই ভাস্করকে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে। সেই ভাস্করের স্থান এখন পাঠ্যবইয়ে। ষষ্ঠ শ্রেণির 'লাইফ এন্ড লাইভলিহুড' বইয়ে "আ টেকনোলজিক্যাল ভিশনারি ভাস্কর ভট্টাচার্য" শিরোনামে ভাস্করের জীবনের গল্প লেখা হয়েছে।
ভাস্কর বলেন, "পেলের যেদিন মৃত্যু হলো, সেদিন আমি প্রথম জানতে পারি আমার কথা বইয়ে যুক্ত হয়েছে। আমি ভীষণ অবাক হয়েছি। কালো মানিক পেলের জীবনী আমরা ক্লাস ফাইভে পড়েছি। মানুষ আমার জীবনী পড়বে এটা আমার কাছে বিষ্ময়কর। তবে সবচেয়ে ভালো দিক হলো শিশুদের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে যে ভুল ধারণা তা কেটে যাবে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা কিছু পারে না এ ভাবনা বদলে যাবে।"