‘ধামাচাপা’ মানে কী? প্রশ্ন সাগর-রুনির ছেলে মেঘের
খুন হওয়া সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির একমাত্র সন্তান মাহির সরোয়ার মেঘ, তার বাবা-মায়ের হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে এখন সন্দিহান। ইদানিং সে প্রায়ই জিজ্ঞাসা করে, "'ধামাচাপা' (সত্য গোপন করা) এর অর্থ কী? আমার বাবা-মায়ের হত্যা মামলার বিচারের অর্থ কী?"
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার এগারো বছর পেরিয়ে গেলেও এই হত্যা মামলায় উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি।
মেঘের বাবা-মাকে যখন হত্যা করা হয় তখন একই ফ্ল্যাটের অন্য কক্ষে ছিল সে। ছোট্ট সেই মেঘের বয়স এখন ১৬। রুনির ভাই ও মেঘের মামা নওশের আলম রোমান জানান, মেঘ প্রায়ই তার বাবা-মায়ের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে, জানতে চায়।
"যখনই ও (মেঘ) এ ধরনের কোনো কিছু শোনে, তখনই ১১ বছর আগের সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সঙ্গে বিষয়টি সম্পর্কযুক্ত করতে চায়," দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন রোমান।
সাগর-রুনি হত্যা মামলার বাদী রোমান জানান, "মেঘের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য কেউ নেই এখানে।
মেঘ এখন খেলাধুলা, জার্সি ডিজাইনসহ আরও অনেক কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে। শীঘ্রই ও-লেভেল পরীক্ষায় অংশ নেবে সে।
এদিকে, মেয়ে ও জামাই হত্যার বিচারের অপেক্ষায় দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি মারা যান রুনির মা নূর নাহার মির্জা। নওশের আলম রোমান বলেন, "সাংবাদিক সম্প্রদায় সাহসিকতার সঙ্গে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি জানাতে ব্যর্থ হয়েছে।"
ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় জোড়া খুনের মামলা দায়েরকারী বাদী মামলার রহস্য উদঘাটনে র্যাবের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
"আমার সন্দেহ, এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য ফাঁস না করার ব্যাপারে সরকারের শীর্ষ সংস্থাগুলো থেকে কোনো ধরনের নির্দেশনা থাকতে পারে। তবে তা কেন, আমি জানি না।"
তিনি বলেন, "ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা হারালেও আমরা লড়াই চালিয়ে যাবো।"
যোগাযোগ করা হলে র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল-মঈন টিবিএসকে জানান, তারা দক্ষতা, পেশাদারিত্ব এবং নিষ্ঠার সঙ্গে মামলার তদন্ত পরিচালনা করছেন।
"আমরা নিয়মিত আদালতে তদন্তের আপডেট জানাই," যোগ করেন তিনি।
দীর্ঘ ১১ বছরেও সুরাহা হয়নি সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার। নথিপত্র অনুসারে, ডিএনএ এবং অন্যান্য মেডিকেল পরীক্ষায় সুনির্দিষ্ট এবং চূড়ান্ত কিছু পাওয়া যায়নি। তাই খুনের পিছনের উদ্দেশ্য নিয়ে এখনও অন্ধকারে রয়েছেন তদন্তকারীরা।
"চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের বিচারে দীর্ঘ বিলম্ব হওয়ার কারণে মানুষ দেশের তদন্ত ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছে। এটি দেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত নিন্দনীয়," জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান টিবিএসকে বলেন।
কী বলছে কর্তৃপক্ষ?
র্যাবের তদন্তকারী এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার শফিকুল আলম তদন্তে এখনও সুনির্দিষ্ট কিছু খুঁজে পাননি। সাগর-রুনি হত্যা মামলার সপ্তম তদন্তকারী তিনি, ২০১৯ সালের জুলাই থেকে এই মামলার তদন্ত করে আসছেন খন্দকার শফিকুল আলম। সম্প্রতি তিনি আদালতে আরও সময় চেয়েছেন।
গত নভেম্বরে র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল-মঈন সাংবাদিকদের বলেন, "সাংবাদিক দম্পতি হত্যার তদন্ত শেষ করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়া যাবে না।"
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল মাছরাঙার বার্তা সম্পাদক সাগর এবং তার স্ত্রী এটিএন বাংলার রিপোর্টার রুনিকে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তাদের নাবালক ছেলের উপস্থিতিতেই ঢাকার পশ্চিম রাজা বাজার এলাকায় ভাড়া বাসাতে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়।
পুলিশি তদন্তের পর ২০১২ সালের এপ্রিলে মামলাটি হস্তান্তর করা হয় র্যাবের কাছে। সর্বশেষ চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর হাকিম আদালত মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময়সীমা ৫ মার্চ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেন। ৯৫ বারের মতো বাড়ানো হয় এই মামলার তদন্তের সময়সীমা।
হত্যাকাণ্ডের পর সাগর-রুনির পারিবারিক বন্ধু তানভীর আহমেদ, এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবির, রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মিতু ওরফে বারগিরা মিন্টু ওরফে মাসুম মিন্টু, কামরুল হাসান অরুন, পলাশ রুদ্র পাল ও আবু সাঈদ-সহ অন্তত আটজনকে গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তানভীর ও পলাশ জামিন পেলেও বাকি ছয়জন বছরের পর বছর ধরে কারাগারে রয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, "খুনের ঘটনা ঘটেছে বহু বছর হয়ে গেছে। আমরাও রহস্য উদঘাটন করতে চাই। কেন দুই প্রতিশ্রুতিশীল সাংবাদিককে হত্যা করা হলো, আমরা তা জানতে চাই। আমি র্যাবের মহাপরিচালককে তাদের তদন্তের বিষয়ে দ্রুত জানাতে নির্দেশ দেব।"
এর আগে, র্যাবের এক তদন্তকারী জানিয়েছিলেন, ২৫ জনের গালের ভেতরের অংশ থেকে নেওয়া নমুনা (সোয়াব) এবং ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হলেও সেখান থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট কিছু জানানো সম্ভব হয়নি।