কৃষকরা যেভাবে কৃষিকে আধুনিক করছেন
চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের, যেমন বীজ, সারের দাম দিন দিন বাড়ছে। বাড়ছে সেচ খরচ এবং শ্রমিক ঘাটতিও। এ কারণে প্রতিনিয়তই কৃষিকাজের খরচ বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে আশার আলো দেখাচ্ছে 'সমলয়' নামের নতুন চাষাবাদ পদ্ধতি।
প্রথাগত চাষাবাদ থেকে এই চাষপদ্ধতি একটু ভিন্ন।
সমলয় পদ্ধতিতে ভিন্ন ভিন্ন জমিতে পৃথক জাতের ধান চাষ না করে কৃষকরা একটি জমিতে সব প্লটে একই জাতের ধান রোপণ করেন। এই পদ্ধতিতে চারা রোপণ থেকে শুরু করে সবগুলো প্লটে ফসল কাটা পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে একই সময়ে সম্পাদিত হয়।
জমির অপচয় রোধে প্রচলিত পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরি না করে প্লাস্টিকের ফ্রেম বা ট্রেতে বীজ রোপণ করা হয়। ২০ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে চারা রোপণের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। প্রস্তুত হয়ে গেলে রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার ব্যবহার করে চারা রোপণ করা হয়। একই সময়ে সব চারা রোপণের কারণে একটি নির্দিষ্ট এলাকার সমস্ত প্লটের ফসল একই সময়ে পাকে। ফলে সব প্লটের ধান একসঙ্গে মেশিন দিয়ে কাটা ও মাড়াই করা যায়।
চাষ পদ্ধতিটি যেহেতু বৃহৎ পরিসরে প্রয়োগ করা হয়, তাই পুরো প্রক্রিয়ায় যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে পদ্ধতিটি সাশ্রয়ীও বটে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'সমলয় চাষাবাদ হলো, আমরা একই সময় ফসল লাগাব, আবার একই সময় মেশিনে ফসল কাটব।'
তিনি আরও জানান, সময়ল পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে উৎপাদন খরচ অন্তত ২৫ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ কম হয়।
কৃষি অধিদপ্তরের সঙ্গে ব্রিও সমলয় পদ্ধতিতে চাষ করা কৃষকদের নানাভাবে সাহায্য দিচ্ছে বলে জানান শাহজাহান। ব্রির ১১টি আঞ্চলিক কার্যালয় ও প্রধান কার্যালয়ে ধান কাটার মেশিন আছে। ব্রি উদ্ভাবিত এই মেশিনগুলো বিভিন্ন স্থানের কৃষকদেরকে ধান কাটার জন্য বিনামূল্যে দেওয়া হবে।
কৃষি তথ্য সার্ভিস-এর (এআইএস) তথ্য বলছে, ধানচাষ লাভজনক করার পথ হলো উৎপাদন ব্যয় কমানো। আর উৎপাদন কমাতে হলে সমলয় চাষের বিকল্প নেই।
ব্রির গবেষণার তথ্য বলছে, সমলয় পদ্ধতিতে ধান চাষ করলে উৎপাদন ব্যয় কমছে অন্তত ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। পাশাপাশি বেড়ে যাচ্ছে কৃষকের লাভ। এর মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে আধুনিক চাষাবাদেও অভ্যস্ত হতে শুরু করেছেন দেশের কৃষকরা।
কর্মকর্তারা জানান, কৃষকদেরকে উদ্বুদ্ধ করে এই পদ্ধতি জনপ্রিয় করতে সরকার সমলয় চাষাবাদে ব্যাপক প্রণোদনা দিচ্ছে।
সরকারি উদ্যোগে যে কৃষি ব্লকগুলো তৈরি করা হয়েছে, সেখানে কৃষকদের বিনামূল্যে বীজ দেওয়া হয়েছে। বীজতলা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় প্লাস্টিক ট্রে দেওয়া হয়েছে। রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টারের মাধ্যমে যে বীজ রোপণ করা হয়েছে, তার খরচও সরকার দিচ্ছে। ব্লকের জমিগুলোতে যতটুকু রাসায়নিক সার দরকার, তার সবটাই বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। ধান পাকলে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টরের মাধ্যমে কেটে মাড়াই, ঝাড়াই করে বস্তায় তোলা পর্যন্ত কাজগুলোও করা হবে মেশিনের মাধ্যমে—এর খরচও সরকার বহন করছে।
কর্মকর্তারা বলেন, উৎপাদন খরচ কম পড়ায় এবং লাভের মার্জিন বেশি হওয়ায় কৃষকরা দিন দিন সমন্বিত পদ্ধতিতে ধান চাষে আরও উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।
২০১৯-২০ সালে ১২টি জেলায় সমলয় পদ্ধতিতে চাষ করা হয়। ওই সময় প্রদর্শনী আকারে ৬০০ একর জমিতে বোরো চাষ করা হয়। এ থেকে সফলতা পাওয়ার পর থেকেই কৃষকদের মধ্যে বাড়তে থাকে নতুন চাষপদ্ধতির জনপ্রিয়তা।
চলতি বোরো মৌসুমে ৬১ জেলার মোট ৫ হাজার ৫৫০ একর জমিতে ১১০টি ব্লক সমলয় পদ্ধতিতে চাষ করা হচ্ছে। এগুলো সবই হচ্ছে সরকারি প্রণোদনার আওতায়। এছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকরা নিজ খরচেই এই পদ্ধতিতে চাষ করছেন।
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার তিন গ্রামের ১০৯ জন কৃষক একসঙ্গে ৫০ একর জমিতে সমলয় পদ্ধতিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের বোরো ধান রোপণ করেছেন।
বুড়িচং উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা সুলতানা ইয়াসমিন বলেন, 'প্রথমে আমরা কৃষকদের এ পদ্ধতিতে চাষাবাদের সুফল বুঝিয়েছি। এরপর তাদের সরকারি সহায়তার কথা জানানো হয়েছে। আমরা ১০৯ জন কৃষকে এক করেছি। তবে জমির বাউন্ডারি ঠিক রেখেই এই চাষাবাদ করা হচ্ছে।'
বুড়িচং এলাকার কৃষক মোহাম্মদ মাহাবুবের এক একর জমি রয়েছে একটি ব্লকে। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'আমরা তিন গ্রামের কৃষকের জমি একসঙ্গে করে বোরো ধান লাগিয়েছি। ধান লাগানো হয়েছে রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টারের মাধ্যমে। আবার কাটা ও মাড়াইও করা হবে কৃষিযন্ত্রের মাধ্যমে।
'সরকার সার বীজ, বীজতলার জন্য ট্রে, ধান রোপণের খরচ দিয়েছে। জমি তৈরি ও পানি দেওয়ার জন্য টাকাটা এবার শুধু আমাদের খরচ।'
টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি উপজেলার নরিল্যা গ্রামে ৫০ জন কৃষক একসঙ্গে সমলয় ব্লকে বোরো চাষ করছেন। এই গ্রামের কৃষক ইমাম হোসেনের ব্লকে জমি রয়েছে ৫ বিঘা। তিনি টিবিএসকে বলেন, আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার ও সমন্বিত চাষের কারণে ধানের উৎপাদন খরচ অনেক কমে গেছে।
ইমাম জানান, আগে এক বিঘা জমিতে ধান লাগাতে খরচ পড়তো ২ হাজার টাকা। কিন্তু রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টারে এই খরচ ১ হাজার টাকার মতো।
ইমাম বলেন, 'জমি তৈরি করা ও পানির খরচ ছাড়া সার, বীজ, ধান রোপণ, কাটা পর্যন্ত সব খরচই এবার সরকার দিচ্ছে। এবার সরকার এই খরচ দিলেও আমরা আগামীতে নিজেরাই করব।'
প্রচলিত পদ্ধতিতে এক হেক্টর জমিতে ধানের চারা রোপণ করতে এলাকাভেদে খরচ হয় প্রায় ১২ থেকে ১৬ হাজার টাকা, যেখানে রোপণ যন্ত্র (রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার) ব্যবহার করলে ব্যয় থাকে ১০ হাজার টাকার টাকার মধ্যে।
একইভাবে ধান কাটার ক্ষেত্রেও সময়স্বল্পতা এবং সারা দেশে প্রায় পাশাপাশি সময়ে কর্তনকাজ শুরু হওয়ায় শ্রমিকের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দেয়। এক্ষেত্রে একটি কম্বাইন্ড হারভেস্টার দিয়ে ধান কাটলে হেক্টরপ্রতি ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার টাকা খরচ হয়—সেখানে শ্রমিক দিয়ে কাটা, পরিবহন, মাড়াই ও ঝাড়াই বাবদ এলাকাভেদে প্রায় ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। এই হিসাবে শুধু রোপণ ও কাটায় যান্ত্রিকীকরণ করা সম্ভব হলে ধানের উৎপাদন খরচ হেক্টরপ্রতি প্রায় ২০ হাজার টাকার বেশি সাশ্রয় করা সম্ভব।
সরকারি প্রণোদনার মাধ্যমে চৌগাছা উপজেলার মাঠপাড়া গ্রামে গত বছর একটি ৫০ একর জমির ব্লকে চাষ করেছিলেন কৃষকরা, যার পুরোটাই ছিল কৃষিযন্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে। এটা দেখে গত বছর নিজ খরচে একই উপজেলার আরেক গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম উদ্যোগী হয়ে ১২ জন কৃষককে সঙ্গে নিয়ে নিজ খরচে সমলয় পদ্ধতে জমি চাষ করেন। এবার আরও নতুন ১০ জনকে নিয়ে মোট ২২ জন কৃষক একসঙ্গে হয়ে ৫০ বিঘা জমি চাষ করছেন।
নজরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, সাধারণ পদ্ধতিতে আগে চাষ করে যেখানে প্রতি বিঘায় ফলন পাওয়া যেত ২০-২১ মণ ধান, গত বছর সেখানে নতুন পদ্ধিতে চাষ করে ২৪ মণ ধান পাওয়া গেছে। এছাড়া সমলয় পদ্ধতিতে ধান চাষের খরচও কম বলে জানান তিনি।
কৃষি অধিদপ্তর বলছে, ছোট ছোট জমিতে বড় কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার কষ্টকর। তাই এলাকাভিত্তিক কৃষকদেরকে সংগঠিত করে অধিক জমিতে কৃষিযন্ত্রের মাধ্যমে একই সময়ে, উন্নত মানের একই জাতের ধান লাগানো হয়েছে। এতে করে ধানগুলো একসঙ্গে পাকলে সহজেই যন্ত্র দিয়ে কাটা সম্ভব হবে। এতে করে একদিকে যেমন কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে, অন্যদিকে সব জমি একসঙ্গে চাষ করায় উৎপাদন খরচও কম পড়ছে।
আবার যেকোনো ধরনের প্রকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার জন্যও এই পদ্ধতির চাষাবাদ ব্যপক উপকারী। কারণ ফসল পেকে যাওয়ার পর কোনো দুর্যোগের পূর্বাভাস পেলে সহজেই ফসল কেটে ফেলা যাবে কৃষিযন্ত্রের মাধ্যমে। এতে যে সময় লাগবে, একই সময়ে শ্রমিক দিয়ে এটা করা সম্ভব হয় না।
কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানিকারক ও সরবরাহকারী মেটাল (প্রাইভেট) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদিদ জামিল টিবিএসকে বলেন, 'এখন পর্যন্ত খামার যান্ত্রিকীকরণে আমাদের সাফল্য শুধু জমি চাষ, সেচ ও মাড়াইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এসব কাজের ৯৫ শতাংশ বা তার কিছু বেশি যন্ত্র দিয়ে করা হয়। কিন্তু ফসল কাটায় যান্ত্রিকীকরণের হার মাত্র ৫-৬ শতাংশ, যা চারা রোপণের তুলনায় কম।'
তিনি বলেন, 'ফসল কাটা ও চারা রোপণের যান্ত্রিকীকরণে আমরা পিছিয়ে থাকায় কৃষক ও দেশ উভয়ের বড় ক্ষতি হচ্ছে।' কৃষির যান্ত্রিকীকরণ জরুরিভাবে প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস টিবিএসকে বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও শ্রমিক সংকট মোকাবিলায় কৃষি যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে সরকার যন্ত্র কেনায় ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দিচ্ছে। 'কারণ উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে বাড়তি লাভের জন্য আধুনিক কৃষির বিকল্প নেই, আধুনিক কৃষির জন্য যন্ত্রের ব্যবহার করতেই হবে।'
সহজে কৃষি যন্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন থেকে শুরু করে মাড়াই পর্যন্ত যন্ত্রের ব্যবহার করার জন্য সমলয় পদ্ধতির বিকল্প নেই। বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, 'এটা হচ্ছে আধুনিক বা স্মার্ট কৃষির একটি পদ্ধতি। এখন আমরা এটা কৃষকদেরকে উদ্বুদ্ধ করছি, পরবর্তীতে তারা অভ্যস্ত হয়ে গেলে নিজেরাই একসঙ্গে করতে থাকবেন।'