সিলেটে ’৭১-এর বধ্যভূমিতে নির্মিত হলো শহীদ স্মৃতি উদ্যান
সিলেটের অন্যতম বড় বধ্যভূমির একটি সালুটিকর এলাকায়। একাত্তরে এখানকার সিলেট ক্যাডট কলেজে ক্যাম্প গড়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। সেই ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাসহ বাঙালিদের ধরে এনে হত্যা ও নির্যাতন করা হতো। হত্যার পর দুই শতাধিক ব্যক্তিকে ক্যাডেট কলেজের পেছনেই গণকবর দেওয়া হয়।
এসব তথ্য জানা ছিল এখানকার প্রায় সবার। ছিল মুখে মুখে, বইয়ের পাতায়। কিন্তু শহিদদের স্মরণে ছিল না কোনো স্মৃতিচিহ্ন। সালুটিকরের এই গণকবরটি এতদিন পড়েছিল পরিত্যক্ত অবস্থায়। সেনানিবাসের সংরক্ষিত এলাকায় এই বধ্যভূমির অবস্থান হওয়ায় সাধারণের প্রবেশাধিকারও ছিল না এতদিন। এমনকি এখানে কাদের হত্যা করা হয়, সেই তালিকাও ছিল না কোথাও।
তবে সেই না থাকার আফসোস ঘোচাতে এগিয়ে এলেন দুজন মুক্তিযোদ্ধা। মানুষ এসে যেনো এই শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারেন, সেজন্য এখানে তারা নির্মাণ করেছেন মেমোরিয়াল পার্ক।
বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব) মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বীর প্রতীক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদের উদ্যোগে ও অর্থায়নে সালুটিকর বধ্যভূমিতে গড়ে উঠেছে নান্দনিক 'স্বাধীনতার শহিদ স্মৃতি উদ্যান'। ফলে স্বাধীনতার ৫২ বছর পর প্রথমবারের মতো এই শহিদদের স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পেলেন তাদের স্বজনরা।
তাদেরই একজন রীনা চক্রবর্তী। একাত্তরে রীনা চক্রবর্তী যখন মায়ের গর্ভে, তখন পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করে তার বাবা গকুলানন্দ চক্রবর্তীকে। বাবার মৃত্যুর কয়েক মাস পর জন্ম হয় তার। এতোদিন কেবল গল্প শুনেছেন বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হয়েছেন। কিন্তু কোথাও বাবার কোনো স্মৃতিচিহ্ন ছিল না।
অবশেষে ৫২ বছর পর বাবার স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পেলেন রীনা। কখনো না দেখে বাবার স্পর্শ পেলেন যেনো!
"বাবাকে আমি কখনো দেখিনি। কোথাও তার স্মৃতিচিহ্নও ছিল না। ৫২ বছর পর আজ এই বধ্যভূমিতে তার একটি স্মৃতিফলক লাগানো হলো। এই প্রথম যেনো আমি বাবার স্পর্শ পেলাম," সালুটিকর বধ্যভূমিতে শহিদ গকুলানন্দ চক্রবর্তীর স্মৃতিফলকে হাত বোলাতে বোলাতে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এ কথা জানালেন রীনা চক্রবর্তী।
রীনা চক্রবর্তীর মতো ৬৬টি পরিবার শনিবার প্রথমবারের মতো দেশের জন্য আত্মোত্যাগকারী তাদের শহিদ স্বজনদের স্মৃতিচিহ্নের সন্ধান পেয়েছেন এই বধ্যভূমিতে।
কর্নেল (অব) মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বীর প্রতীক ও অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ খুঁজে খুঁজে এখানে শায়িত শহিদদের নাম ঠিকানাও বের করছেন। এ পর্যন্ত ৬৬ জনের পরিচয় বের করতে পেরেছেন তারা। শহিদদের নামে এই উদ্যানে নির্মাণ করা হয়েছে আলাদা আলাদা স্মৃতিস্তম্ভ।
শনিবার (৪ মার্চ) এই শহিদ স্মৃতি উদ্যানের উদ্বোধন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদ স্বজনরা।
৫২ বছর ধরে বাবার কবর খুঁজছেন শাহরীন রহমান লুবনা। তার বাবা শহীদ কর্ণেল ডা. আবু ফজল জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় সিলেট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। '৭১ এ বাবাকে সিলেটে হত্যা করে পাকবাহিনী, এটুকুই কেবল জানতেন শাহরীন। কিন্তু কোথায়, কীভাবে হত্যা করা হয় তার কোনো তথ্যই জানতেন না।
শাহরীন বলেন, "৫২ বছর ধরে আমি বাবার স্মৃতিচিহ্ন খুঁজছি। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি। কিন্তু কোথাও পাইনি। অবশেষে, আজ বাবার স্মৃতি খুঁজে পেলাম।"
এমন উদ্যোগ যারা নিয়েছেন তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, "তারা একটি অসাধ্য সাধন করেছেন। যেনো আমার বাবাকেই আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন।"
শহিদ স্মৃতি উদ্যানের উদ্বোধন করেন শহিদ সিরাজুল আবদালের স্ত্রী সৈয়দা সকিনা আবদাল। উদ্বোধনকালে কান্না ছাড়া কোনো কথা বলতে পারেননি সকিনা আবদাল।
তাদের ছেলে মেজর ডা. (অব) সৈয়দ জামিল আবদাল বলেন, "একাত্তরে বাবা এখানকার চা বাগানে চাকরি করতেন। চাকরি ছেড়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তাকে পাকিস্তানি আর্মিরা ধরে এখানে এনছিল বলে জেনেছিলাম। কিন্তু পরে আর কোনো খোঁজ পাইনি। আজ এতোদিন পর তার স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পেলাম। এই প্রথম মনে হচ্ছে আমার বাবাকে স্বীকৃতি দেওয়া হলো।"
শহিদ স্মৃতি উদ্যান ঘুরে দেখা যায়, বিশাল চত্বরে নির্মাণ করা হয়েছে দুটি স্মৃতিস্তম্ভ। একটি স্তম্ভে রয়েছে, এখানে শায়িত সব শহিদদের নাম। এছাড়া, সব শহিদদের জন্য কবরের আদলে অলাদা আলাদা স্মৃতিফলকও রয়েছে। নানা জাতের ফুল ও ফলের গাছ রোপন করা হয়েছে উদ্যানজুড়ে। এছাড়া, বিভিন্ন স্থানে লেখা রয়েছে এই উদ্যান নির্মাণের পটভূমি ও এখানে শায়িত সব শহিদদের জীবনী।
এই স্মৃতি উদ্যানে পাঠাগার, যাদুঘর, কফিশপ এবং আলাদা বসার জায়গা নির্মাণ করা হবে বলে জানান উদ্যোক্তারা। এছাড়া, এখানে গণকবর দেওয়া বাকি শহিদদের চিহ্নিত করে তাদেরও স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
উদ্যোক্তাদের অন্যতম বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ। তার বাবা শহিদ বুদ্ধিজীবী ডা. শামসুদ্দিন আহমদকে সিলেট মেডিকেলে কর্মরত অবস্থায় হত্যা করে পাকিস্তানিরা। বাবাকে যখন পাকিস্তানিরা হত্যা করে তরুণ জিয়াউদ্দিন তখন যুদ্ধে।
এই উদ্যোগ প্রসঙ্গে ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ বলেন, "আমরা কেবল বলি ৩০ লাশ শহিদ। কিন্তু তাদের পূর্ণাঙ্গ কোনো তালিকা নেই। কাকে কোথায় হত্যা করা হয়েছে, কোথায় কবর দেওয়া হয়েছে, কেউ জানে না। আমরা এসব খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। সে লক্ষ্যে ২০১৭ সালে সালুটিকর বধ্যভূমিকে উদ্যান করার উদ্যোগ নেই।"