চট্টগ্রামে বছরে ১৫০ কোটি টাকার নার্সারি ব্যবসা, চলে সারাবছর
এক সময় নার্সারি ব্যবসা শুধু ফুলের মালা, বুকেট কিংবা গাছের চারা বিক্রিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে বদলেছে এই ব্যবসার ধরন। এখন বাসাবাড়ির বারান্দা আর ছাদে গাছ লাগানোর পাশাপাশি শহরের অফিস–রেস্তোরাঁয়ও সৌন্দর্যবর্ধনের অন্যতম অনুষঙ্গ নানান জাতের গাছগাছালি। এমনকি অনুষ্ঠানেও শোভা বাড়াতে নার্সারি থেকে গাছগাছালি ভাড়া নিয়ে আসেন আয়োজকরা। প্রতিষ্ঠিত নার্সারির পাশাপাশি অনেকে বাড়ির ছোট্ট আঙ্গিনায় উৎপাদিত গাছের ছাড়া বিক্রি করছেন অনলাইনে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের পাশাপাশি আমদানিও হচ্ছে গাছের চারা। আর এতে দিন দিন বেড়ে চলেছে চট্টগ্রাম নগরীর নার্সারি ব্যবসা।
নগরীর নার্সারি মালিকরা জানান, চট্টগ্রামে গাছগাছালি বেচাকেনার পাশাপাশি নার্সারিকে কেন্দ্র করে বাগান পরিচর্যার বিভিন্ন উপকরণ, যন্ত্রপাতি বিক্রি; এমনকি মালি সরবরাহের ব্যবসাও পরিচালিত হয় নার্সারি থেকে। কাঠ এবং ভেষজ উদ্ভিদসহ নানান জাতের ফুল-ফলের গাছ বিক্রি করে এই খাতে প্রতিবছর অন্তত ১৫০ কোটি টাকার বাণিজ্য হয় চট্টগ্রামে।
বর্তমানে চট্টগ্রাম নগর ও আশপাশের বিভিন্ন উপজেলায় ছোট, মাঝারি ও বড় মিলিয়ে প্রায় ৫০০ নার্সারি রয়েছে। এরমধ্যে ছোট আকারের ৩০০ ও মাঝারি ১৫০টি। বাকিগুলো বড় আকারের। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকায় নার্সারি আছে প্রায় ১৫০টি। নগরের ডিসি হিল, আন্দরকিল্লা, লালদিঘী, বহদ্দারহাট, দেওয়ানহাট, ওয়াসার মোড়, কোতোয়ালী মোড়, এমএআজিজ স্টেডিয়াম, হালিশহর, পাহাড়তলী, চাঁদগাও, আগ্রাবাদ, ও ফতেয়াবাদ এলাকায় অধিকাংশ নার্সারি গড়ে উঠেছে।
সরেজমিনে ঘুরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, বর্তমানে ছোট আকারের একটি নার্সারিতে দৈনিক গড়ে ৭ থেকে ৮ হাজার, মাঝারি নার্সারিতে ১০ থেকে ১৫ হাজার এবং বড় নার্সারিতে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকার গাছ বিক্রি হচ্ছে।
সব মিলিয়ে চট্টগ্রামের প্রায় ৫০০ নার্সারিতে দৈনিক গড়ে ৩০ লাখ টাকা এবং বছরে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার গাছ কেনাবেচা হয়। তবে শীত ও বর্ষার শুরুতে বিক্রির পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
চট্টগ্রাম নার্সারি সমিতির অর্থ সম্পাদক ও বনরুপা নার্সারীর স্বত্বাধিকারী রাহুল রায় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আগে মানুষ নার্সারি ব্যবসা বলতে শুধু ফুল বা ফুলের গাছ বিক্রিকে বুঝতো। কিন্তু এখন এই ব্যবসার পরিধি ও ধরন দুটোই বদলেছে।
"আমরা যে শুধু গাছ বিক্রি করি তা নয়, গাছের পাশাপাশি বাগান পরিচর্যার বিভিন্ন সামগ্রী, কিটনাশক এমনকি মালিও সরবরাহও করছি," যোগ করেন তিনি।
বিক্রয়কর্মীরা জানান, নার্সারীগুলো বর্ষা ও শীত মৌসুমকে টার্গেট করে তাদের বিক্রয় কৌশল সাজান। বিশেষ করে শীতের শুরুতে গাঁদা, ডালিয়া, বেলি, জুঁই, জবা, চামেলি, কাঠগোলাপ, হাসনাহেনা, চন্দ্রমল্লিকা, জারবেরা, কসমস, পিটুনিয়ার ফুরের চারার চাহিদা বেশি থাকে। আবার বর্ষার শুরুতে লেবু, কামরাঙা, মাল্টা, কতবেল, পেয়ারা, আমলকী, চেরি, আমড়া, বরই ইত্যাদি ফলের গাছও ভালো বিক্রি হয়।
ফুলের মধ্যে গোলাপ এবং ফলের মধ্যে আমের চাহিদাই সারা বছরই থাকে। এছাড়া, সব ধরনের সবজি ও ভেষজ উদ্ভিদও এখন নার্সারিতে পাওয়া যায়। এরমধ্যে মধ্যে মরিচ, টমেটো, ঢেঁড়স, লাউ, শিম, পুদিনা, তুলসী ও অ্যালোভেরার চাহিদা বেশি। এসব গাছ ১০ টাকা থেকে শুরু করে ৫ হাজার টাকায়ও বিক্রি হয়।
এর বাইরে ইনডোর বা ঘরসজ্জার জন্য ক্যাকটাস, অর্কিড, সাকুল্যান্ট, পাইকাস, মনস্টেরা, মানিপ্ল্যান্ট, বিভিন্ন প্রজাতির ফার্ন, এরিকা পাম, অগ্নিশ্বর, অ্যাগলোনিমা ইত্যাদির চাহিদা বেশি। আকার ও প্রজাতিভেদে এসব গাছের একেকটির দাম ২৫০ থেকে হাজার টাকার মধ্যে।
নার্সারিগুলো দেশিয় গাছের পাশাপাশি আমদানি করা বিদেশি গাছও বিক্রি করে।
বনরুপা নার্সারির স্বত্বাধিকারী রাহুল রায় জানান, তারা প্রতিবছর ভারত, ইতালি ও থাইল্যান্ড থেকে ফল, ফুল ও অর্নামেন্টাল গাছের প্রায় ১০ হাজার চারা আমদানি করেন। বড় বড় কর্পোরেট হাউস ও ডেভলপার প্রতিষ্ঠান এসব গাছের ক্রেতা।
গাছ ভাড়া করা
বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি অফিসে সৌন্দর্যবর্ধনে গাছ ভাড়া নেওয় হয়। চট্টগ্রামের বেশকিছু নার্সারি চুক্তির ভিক্তিতে এই ব্যবসা করে। তারা গ্রাহকের চাহিদা অনুসারে পরিচর্যার পাশাপাশি প্রতিমাসে গাছ প্রতিস্থাপনও করে দেয়। এছাড়া, অনেকেই পেশাদার নকশাকারক ও স্থপতিদের দিয়েও সবুজায়ন করান।
বাংলাদেশ নার্সারির কর্মকর্তা আলি হোসেন জানান, তারা প্রতিটি গাছের ভাড়া নেন ৭০ থেকে ১০০ টাকা। অফিসগুলো সাধারণত ফিলোডেনড্রন, এরিকা পাম, ড্রাসিনা, পথোস বা মানিপ্ল্যান্ট, অ্যাগলোনিমা, পিস লিলি, লেমন লাইম-এসব গাছ বেশি ভাড়া নেয়।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল হাশেম জানান, সড়কের আইল্যান্ডসহ বিভিন্ন স্থাপনা সবুজায়নে চসিক ও তাদের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় নার্সারিগুলো থেকে প্রতি মৌসুমে কয়েক লাখ টাকার চারা ক্রয় করে।
নার্সারি ব্যবসা এখন অনলাইনে
এখন অনলাইনে গাছগাছালি বেচাকেনারও বাজার গড়ে উঠেছে। চট্টগ্রামে অন্তত ১০ জন উদ্যোক্তা রয়েছেন, যারা অনলাইন নার্সারি ব্যবসা পরিচালনা করেন। এ রকমই এক প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী অতনু সেন।
পড়ালেখার পাশাপাশি ফেসবুকে নিজের নার্সারি ব্যবসার বিষয়ে তিনি জানান, অনলাইনে বেশ ভালো কেনাবেচা করেন তিনি। সৌখিন মানুষদের পাশাপাশি বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানও তার কাছ থেকে গাছ কেনে। মূলত ব্যক্তি উদ্যোগে তৈরি চারাগাছগুলো তিনি চুক্তিতে বিক্রি করেন। মাস শেষে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় হয় অতনুর।
বাংলাদেশ নার্সারির স্বত্বাধিকারী আবুল হোসেন জানান, প্রতি মাসে তার প্রায় ৫ লাখ টাকার কৃষি উপকরণ ও যন্ত্রপাতি বিক্রি হয়। ছাদবাগানের বিকাশের ফলে শহরে এখন মালিসেবাও জনপ্রিয় হচ্ছে। চট্টগ্রামে তার মতো অন্তত ১০ জন ব্যবসায়ী রয়েছেন।
চট্টগ্রাম নার্সারি সমিতির উপদেষ্ঠা ও ফতেয়াবাদ নার্সারির স্বত্বাধিকারী জসিম উদ্দিন বলেন, করোনার পর ব্যবসার অবস্থা কিছুটা পরিবর্তন হতে না হতেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে নার্সারি ব্যবসায়। এতে প্রতিটি দেশি গাছের দাম বেড়েছে ৫ থেকে ১০ টাকা আর বিদেশি গাছের দাম ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত।
তিনি বলেন, "স্থায়ী বিক্রয়কেন্দ্র না থাকায় আমাদের বিদ্যুৎ-পানি ও ট্রেড লাইসেন্স পেতে সমস্যায় পড়তে হয়। প্রায়ই বিভিন্ন সংস্থার দ্বারা উচ্ছেদেরও শিকার হতে হয়।"
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, "চট্টগ্রামের অধিকাংশ নার্সারি সরকারি জায়গা, ফ্লাইওভারের নিচে বা ফুটপাতে ভাসমান অবস্থায় কার্যক্রম পরিচালনা করে। তাই বিধি অনুযায়ী অনেককে ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার সুযোগ নেই।"