ত্রিপুরায় পাথরের বাজার হারাচ্ছে বাংলাদেশ
ভারতের ত্রিপুরায় পাথরের বাজার হারাতে বসেছে বাংলাদেশ। মূলত ত্রিপুরার সঙ্গে মেঘালয়সহ অন্য রাজ্যের সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় ক্রমাগত কমছে আখাউড়া স্থল বন্দর দিয়ে পাথর রপ্তানির পরিমাণ।
ত্রিপুরার বড় ব্যবসায়ীরা এখন মেঘালয় থেকে স্বল্প খরচে পাথর নিয়ে আসছেন ট্রেনে করে। তবে রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ না থাকলেও ত্রিপুরা থেকে তুলনামূলক কম দামে পাথর আমদানি করতে চান বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা। এক্ষেত্রে পাথর আমদানিতে শুল্ক কমানোর দাবি তাদের।
সিলেটের তামাবিল স্থলবন্দর দিয়ে মেঘালয় থেকে আমদানি করা পাথরই আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ত্রিপুরায় রপ্তানি করেন ব্যবসায়ীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৪ সালে সর্বপ্রথম আখাউড়া স্থল শুল্ক স্টেশন দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্য রপ্তানি বাণিজ্যের সূচনা হয়। এরপর ২০১০ সালের আগস্টে পূর্ণাঙ্গ বন্দর হিসেবে যাত্রা শুরু করে আখাউড়া স্থলবন্দর। দেশের অন্যতম বৃহৎ ও রপ্তানিমুখী এ স্থলবন্দর দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে রপ্তানিকৃত পণ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে চাহিদা সম্পন্ন ছিল পাথর।
কয়েক বছর আগেও প্রতিদিন আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ত্রিপুরায় রপ্তানি হতো শতাধিক ট্রাক ভাঙা পাথর। প্রতিটন পাথরের রপ্তানি মূল্য ছিল ২৫ মার্কিন ডলার। আর এসব পাথর মেঘালয় থেকে আমদানি হতো মাত্র ৮ থেকে ১০ ডলারে। স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের রাজস্ব আদায় এবং সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় উৎস ছিল এই রপ্তানিকৃত পাথর।
তবে পাথর রপ্তানি বাণিজ্যে ধস নামতে থাকে ২০১৭ সালের পর থেকে। ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা শহরের সাথে সরাসারি রেল যোগাযোগ চালু হওয়ার পর থেকেই আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে পাথর আমদানি কমিয়ে দেন সেখানকার ব্যবসায়ীরা। আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে তারা এখন পাথর সংগ্রহ করছেন নিজ দেশ থেকেই।
বর্তমানে সিলেট এবং বিভিন্ন স্থানের নদী থেকে পাওয়া ক্ষুদ্রাকৃতির পাথর আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানি হচ্ছে ত্রিপুরায়। তবে আগে যেখানে প্রতিদিন রপ্তানি হতো শতাধিক ট্রাক পাথর, এখন সপ্তাহে পাথর যাচ্ছে কেবল ৮ থেকে ১০ ট্রাক। প্রতিটন ক্ষুদ্রাকৃতির পাথরের রপ্তানি মূল্য ৩০ ডলার।
আখাউড়া স্থল শুল্ক স্টেশন কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ত্রিপুরায় ভাঙা পাথর রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৫৬ হাজার ৮৪৪ মেট্রিক টন। পরের অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ২ হাজার ৬০০ টনে। ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি হয় ৬ হাজার ৯২৬ মেট্রিক টন। এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৮ হাজার ৫৯৭ মেট্রিক টন। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে গত জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ত্রিপুরায় পাথর রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ৪১২ মেট্রিক টন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ত্রিপুরায় আর পাথর রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ নেই। তবে ত্রিপুরা থেকে পাথর আমদানির মাধ্যমে আখাউড়া স্থলবন্দরের আমদানি বাণিজ্য ফের চাঙা করা যেতে পারে। গত বছরের নভেম্বর মাসে প্রথমবারের মতো আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে চার দফায় ২,৭০০ টন চূর্ণ পাথর আমদানি হয়েছে। প্রতিটনের আমদানি মূল্য ১৩ ডলার। তবে, আমদানিকৃত পাথরের জন্য শুল্ক দেওয়া হয়েছে প্রায় ৬৯ শতাংশ। যদি আমদানি শুল্ক কমানো যায়, তাহলে নিয়মিত পাথর আমদানি করতে চান ব্যবসায়ীরা। এতে করে ব্যবসায়ীরা যেমন লাভবান হবেন, তেমনি সরকারেরও রাজস্ব বাড়বে।
আখাউড়া স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী রাজীব ভূঁইয়া জানান, বাংলাদেশে পাথরের ব্যাপক চাহিদা আছে। এই চাহিদা পূরণে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি করা গেলে ব্যবসায়ীরা যেমন লাভবান হবেন, তেমনি স্থলবন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম আরও বেগবান হবে। এজন্য আমদানি শুল্ক কমাতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
আরেক ব্যবসায়ী মোজাম্মেল হক বলেন, "স্থলবন্দর দিয়ে পাথর রপ্তানি একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। আমরা যে দরে পাথর রপ্তানি করি- তারচেয়ে অনেক কম খরচে ট্রেনে করে মেঘালয় থেকে পাথর নিয়ে আসেন ত্রিপুরার ব্যবসায়ীরা। ফলে বড় ব্যবসায়ীরা আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে পাথর আমদানি বন্ধ করে দিয়েছেন।"
আখাউড়া স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. নাসির উদ্দিন বলেন, "একটা সময় ছিল যখন পাথরবোঝাই ট্রাকের দীর্ঘ সারি থাকত স্থলবন্দরে। সেই চিত্র এখন সোনালী অতীত। ক্রমাগত কমছে পাথর রপ্তানি। বলতে গেলে আমরা পাথরের বাজার হারিয়ে ফেলেছি। এতে ব্যবসায়ীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তেমননি অনেক শ্রমিক কর্মহীন হয়েছে।"
"যেহেতু আমরা আমদানি করা পাথরই রপ্তানি করতাম- সেহেতু পাথর আমদানিতে শুল্ক কমালে আমদানি বাণিজ্য চাঙা হতে পারে। এতে করে বন্দরে কর্মচাঞ্চল্যতা ফিরবে। সরকারেরও রাজস্ব বাড়বে। কারণ দেশে পাথরের ব্যপক চাহিদা রয়েছে," উল্লেখ করেন নাসির উদ্দিন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আখাউড়া স্থলবন্দরের সুপারিনটেনডেন্ট মো. সামাউল ইসলাম জানান, "পাথর রপ্তানি কমার কারণে বন্দরের রাজস্ব আদায় কমেছে। পাশাপাশি সরকার হারাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। তবে ব্যবসায়ীদের পাথর আমদানিতে শুল্ক কমানোর দাবির বিষয়টি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"