১ বিলিয়ন ডলারের সব রপ্তানি শিল্পের জন্য বন্ডেড ওয়্যারহাউজের অনুমোদন প্রধানমন্ত্রীর
তৈরি পোশাক শিল্পের বাইরে রপ্তানিখাতে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের চামড়া, পাট, প্লাস্টিক ও হাল্কা প্রকৌশল শিল্পকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা দেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ধাপে ধাপে দেশের সকল শিল্পখাতকে এ সুবিধা দেওয়া হবে।
রপ্তানি সম্ভাবনা এবং প্রয়োজন বিবেচনায় কোন খাতকে কবে নাগাদ বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা দেওয়া হবে, তার পরিকল্পনা সাজাতে বলেছেন তিনি।
সোমবার (২০ মার্চ) গণভবনে রপ্তানি বিষয়ক জাতীয় কমিটির বৈঠকে এ নির্দেশনাসহ সার্বিক রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ।
২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার পাশাপাশি ২০৩১ সালের মধ্যে ১৫০ বিলিয়ন ডলার এবং পরবর্তী এক দশকে দ্বিগুণ রপ্তানি আয়ের স্বপ্ন বাস্তবায়নে করণীয় সম্পর্কে একটি প্রেজেন্টেশন তুলে ধরেন বাণিজ্য সচিব।
বৈঠকে বিভিন্ন রপ্তানি পণ্যের ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ব্যবসায়ীরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা চেয়েছেন। তাদেরকে নতুন বাজার খুঁজে বের করার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
পাশাপাশি কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ খাতের ব্যবসায়ী ও নারী উদ্যোক্তাদের কার্যক্রম যাতে সহজ হয়, সেভাবে নীতিমালা তৈরির নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।
তপন কান্তি ঘোষ বলেন, "রপ্তানি বাড়াতে নতুন পণ্য লাগবে। দেশে অনেক পণ্য থাকলেও সবগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে নেওয়া যাচ্ছে না।"
"এ প্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে রপ্তানি সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে তিনটি বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সকল প্রতিষ্ঠানকে বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা দেওয়া, নতুবা কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানিতে শুল্ক তুলে নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। উপস্থিত ব্যবসায়ীদের সবাই এসব প্রস্তাব সমর্থন করেছেন," বলেন তিনি।
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানো এবং সবাইকে বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা দেওয়া হবে। তবে সেটা একবারে সম্ভব হবে না। ধাপে ধাপে করতে হবে। এজন্য অধিক সম্ভাবনাময় খাতগুলোকে আগে দেওয়া হবে। বাকিদের সম্ভাবনা বিবেচনায় ধাপে ধাপে দেওয়া হবে।
বাণিজ্য সচিব বলেন, "বর্তমানে লেদার, জুট, প্লাস্টিক ও হালকা প্রকৌশল খাত ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় করছে। যদিও লেদার খাত শর্ত সাপেক্ষে বন্ডেড সুবিধা পায়। এরপরও তাদের সুবিধা দেওয়া দরকার। কারণ দেশে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডাব্লিউজি) শর্ত অনুযায়ী চামড়া উৎপাদন না হওয়ায় কিছু প্রতিষ্ঠান চামড়া আমদানি করে পণ্য তৈরি করছে। তাদেরকে এ সুবিধা দেওয়া দরকার।"
তপন কান্তি ঘোষ বলেন, "সভায় ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট (এফটিএ) নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ধরনের এগ্রিমেন্ট করতে শুল্ক ছাড় দিতে হবে। ৭ থেকে ১০ বছরের মধ্যের পার্টনার কান্ট্রির ৯৮ ভাগ পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশ সুবিধা দিতে হবে। এটা হঠাৎ করে করতে গেলে রাজস্ব আয়ে চাপ পড়তে পারে। আবার স্থানীয় শিল্পও চাপে পড়ার আশংকা রয়েছে। এরপরও এফটিএ করার বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।"
যদিও এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বলেছে, এফটিএর পার্টনার কান্ট্রিকে শুল্ক ছাড় দিতে হলে বর্তমানে যেসব কর অব্যাহতি দেওয়া হয়, সেগুলো প্রত্যাহার করতে হবে।
বাণিজ্য সচিব জানান, বৈঠকে ২০২৬ সালের পরে রপ্তানির বিপরীতে ভর্তুকির পরিবর্তে উৎপাদনে ভর্তুকি দেওয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা ম্যান মেইড ফাইবার, ব্যাকওয়্যার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি, পরিবহন ও গবেষণায় ভর্তুকি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। পাশাপাশি ব্যবসা সহজ করার দাবিও তুলেছেন ব্যবসায়ীরা।
একইসঙ্গে এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ) থেকে বেশি বেশি অর্থায়নেরও প্রস্তাব করেছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া বন্দরে পণ্য খালাস দ্রুত করা, জরিমানা বন্ধ করা এবং নগদ সহায়তার অডিট বন্ধ করার প্রস্তাব করেছেন। একইসঙ্গে সাভারের ট্যানারি শিল্পে দ্রুত কার্যকর সেন্ট্রাল এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিইটিপি) স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বাণিজ্য সচিব বলেন, সভায় ব্যবসায়ীদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে সরকার শ্রম আইন বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কাছে অ্যাকশন প্লান জমা করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশ থেকে শিশু শ্রম নির্মূল করা হবে। পাশাপাশি পরিবেশ সম্মতভাবে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বলা হয়েছে। কারণ সরকার মুজিব ক্লাইমেন্ট প্রসপারেটি প্লান বাস্তবায়ন করবে।
২০২৬ সালে এলডিসি গ্রাজুয়েশনের ফলে বাংলাদেশ যে ট্যারিফ সুবিধা হারাবে, তাতে দেশের রপ্তানি আয় প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার কমে যাওয়ার আশঙ্কার কথা বলেছে পরিকল্পনা কমিশনের স্টাডি। এ অবস্থায় বিশাল রপ্তানি লক্ষমাত্রা তুলে ধরে তা অর্জন করতে কী করণীয় তার বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন বাণিজ্য সচিব।
রপ্তানি লক্ষমাত্রা অর্জনে সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এলডিসি গ্রাজুয়েশনের ফলে বাংলাদেশের ইতিবাচক ব্রান্ডিং তৈরি হবে এবং ব্যবসার পরিবেশ সহজ হবে। এতে ক্রেডিট রেটিং বাড়বে এবং বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে।
'যদিও আমরা বৈচিত্র্য আনতে চাই, পোশাকশিল্পে এখন সুযোগ আগের চেয়ে অনেক বেশি। ভূ-রাজনৈতিক কারণে চীনের বাজারের শেয়ার দ্রুত কমছে, বাংলাদেশ তা থেকে লাভবান হবে। ম্যান মেইড ফাইবার, সার্কুলার প্রোডাকশন ভিত্তিক রপ্তানি রপ্তানির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে," যোগ করেন মন্ত্রী।
এলডিসি গ্রাজুয়েশন পরবর্তী রপ্তানি লক্ষমাত্রা অর্জন করতে সকলখাতে বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা দেওয়ার সুপারিশ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, "মিনিমাম আমদানি মূল্য (এমআইপি), সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি ও রেগুলেটরি ডিউটি প্রত্যাহারের জন্য টাইম বাউন্ড অ্যাকশন প্ল্যান নিতে হবে।"
রপ্তানি বহুমুখীকরণের জন্য ট্যারিফ পলিসি রেশনালাইজ করা, সম্ভাবনাসময় দেশগুলোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করার উপযোগি ট্যারিফ পলিসি প্রণয়ন করা, আন্তর্জাতিক মানের টেস্টিং এন্ড সার্টিফিকেশন ফ্যাসিলিটি গড়ে তোলা এবং আন্তর্জাতিক নেগোসিয়েশনে স্কিল ডেভেলপমেন্ট এর উপর গুরুত্ব দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০২৪-৩৩ মেয়াদের জন্য নতুন জিএসপি পলিসি প্রণয়ন করছে, যা আগামী বছরের শুরু থেকেই কার্যকর হবে। নতুন পলিসির আওতায় বাংলাদেশের বিদ্যমান 'এভরিথিং বাট আর্মস' সুবিধা অব্যাহত রাখতে জরুরি ভিত্তিতে ইইউ এর সঙ্গে সরকারের হাই লেবেল অফিসিয়াল ও পলিটিক্যাল এনগেজমেন্ট প্রয়োজন বলে প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এছাড়া, ভারতে বাংলাদেশ যে ২৫ পণ্য বাদে সকল পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে, এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পরও দেশটি যাতে তা অব্যাহত রাখে সেজন্য উচ্চ পর্যায়ে পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করেছেন বাণিজ্য সচিব।
শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা বাড়াতে কানাডা, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং চীনের সঙ্গে এনগেজমেন্ট বাড়ানোর পাশাপাশি আরসিইপি এবং মারকুসার অঞ্চলের সঙ্গে পলিটিক্যাল এনগেজমেন্ট বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশের শ্রমমান উন্নয়নে ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের দিক থেকে চাপ রয়েছে। এলডিসি গ্রাজুয়েশন পরবর্তী রপ্তানি লক্ষমাত্রা অর্জন করতে হলে শ্রম পরিস্থিতির উন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে বলে প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
শ্রমমান উন্নয়নে ইইউ এর দেওয়া অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়নে ২০২৬ সাল মেয়াদে একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করেছে বাংলাদেশ, যা বাস্তবায়ন করা এবং বাংলাদেশের শ্রম আইন আইএলও'র স্ট্যান্ডার্ডে সংশোধন করার কথা বলেছেন বাণিজ্য সচিব।
তৈরি পোশাক ও নন-আরএমজি খাতে ওয়ার্কিং কন্ডিশনের উন্নতি করা, ২০২৫ সালের মধ্যে শিশু শ্রম দূর করা এবং কারখানায় ইনভায়রনমেন্ট ফ্রেন্ডলি টেকনোলজি ব্যবহারের উপর গুরুত্ব দেন তিনি।