খোলা জায়গায় বসার সুযোগ পেলেও পুঁজির অভাবে দুশ্চিন্তায় বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা
বুধবার (১২ এপ্রিল) থেকে অস্থায়ী দোকান বসিয়ে পুনরায় ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছেন অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা। তবে অস্থায়ী দোকান বসানোর জন্য পুঁজির অভাব ও অব্যবস্থাপনা তাদেরকে হতাশ করে তুলেছে।
সাত বছর আগে বঙ্গবাজারে কাপড়ের দোকানে শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন মুন্সিগঞ্জের মাহবুব ডালি। নিজের জামানো কিছু সঞ্চয় ও আত্মীয়-স্বজন থেকে ৬ লাখ টাকা ধারদেনা করে বছর খানেক আগে দোকান নেন বঙ্গবাজার আর্দশ মার্কেটে।
কিন্ত নির্মম পরিতাপে গত ৪ এপ্রিল লাগা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় মাহবুব ডালির দোকানের ১০ লাখ টাকার মালামাল ও ক্যাশে থাকা নাগদ ৩ লাখ টাকা। সব হারিয়ে মাহবুব ডালি এখন একদম নিঃস্ব।
রাস্তার পাশে ফুটপাতে ইটের ওপর মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন মাহবুব ডালি। চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ নিয়ে দ্য বিসনেস স্ট্যান্ডার্ড কে তিনি বলেন, "শুনেছি যাদের দোকান পুড়েছে, তাদেরকে ওই জায়গায় খোলা আকাশের নিচে দোকান করার সুযোগ দেওয়া হবে, সেই খবর শুনে দেখতে এসেছি।"
"কিন্ত দোকান করার জায়গা পেলেও বা কী করবো? কোনো মালামাল তো আমার কাছে নেই, কোনো পুঁজিও নেই। সকালে ১০০ টাকা পকেটে নিয়ে বের হয়েছি; এইটা ছাড়া বর্তমানে আমার কাছে কোনো টাকাই নেই," যোগ করেন তিনি।
মাহবুব ডালির মতো একই অবস্থা মোহাম্মদ শরীফের। তিনি মেয়েদের পোশাকের ব্যবসা করতেন, শরীফের বঙ্গবাজারে মোট তিনটি দোকানে পুড়ে ৬০ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে।
তিনি টিবিএসকে বলেন, "সব পুড়ে তো পথের ভিখারী হয়ে গেছি। আমার কাছে গতকাল পরিবারের জন্য ইফতার কেনার টাকাটাও ছিল না, দোকান বসানোর জায়গা পেলেও পুঁজি ছাড়া কীভাবে ব্যবসা শুরু করবো?"
এমনি আরেকজন মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। বঙ্গবাজারের দোতলায় তার দুটি দোকান ছিল। আগুনে পুড়ে দোকানের ১ কোটি ৬০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
তিনি বলেন, "ওই রকম ব্যবসা তো আর করতে পারবো না, টাকাও নেই, মালও নেই। একজন মহাজনকে বলেছি বসার সুযোগ দিলে এক/দেড় লাখ টাকা ধার দিতে। এখন সেই আশায়ই রয়েছি।"
শাহ আলম নামে আরেক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী বলেন, "খোলা জায়গায় চৌকি বসানোর সুযোগ দিলেও ২ লাখ টাকার মাল উঠানোর সামর্থ্য নেই আমার।"
বঙ্গবাজারের আগুনের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভাড়ায় দোকান চালানো ব্যবসায়ীরা। তাদের মধ্যে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, "আমরা সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব। কিন্তু দোকান মালিকরা দোকানের জমির বরাদ্দ পেলেও আমরা ভাড়াটিয়া দোকানিরা সবদিক দিয়ে ক্ষতির শিকার হলাম।"
হারুন-অর-রশিদ নামে ক্ষতিগ্রস্ত এক দোকানি বলেন, এখনও দোকান মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি তার। ভয়ে আছেন, মালিক তাকেই চৌকি পেতে দোকান বসাতে দেবেন না-কি, বেশি টাকায় অন্য কাউকে ভাড়া দিয়ে বসেন।
আগুনে পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় বঙ্গবাজারের আশেপাশের মার্কেটগুলো দোকান ভাড়া ও জামানত বেড়ে গেছে বহুগুণ।
রাশেদুল ইসলাম নামে এক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী বলেন, গতকাল পাশের ইসলামিয়া মাকের্টে একটি গুডাউন ভাড়া করতে গেলে তার কাছে দোকান মালিক মাসে ভাড়া চেয়েছেন ৩০ হাজার টাকা। অথচ এই দোকানের ভাড়া আগুন লাগার আগের দিনেও ছিল ৩ হাজার টাকা।
দোকান বসানো নিয়ে অব্যবস্থাপনা
এদিকে, মার্কেটের ২য় ও ৩য় তলাও বহু দোকান ছিল। তাদেরকে কীভাবে নিচে চৌকি পেতে দোকান করার জায়গা দেওয়া হবে, তা নিয়ে উৎকণ্ঠায় আছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা।
তবে বঙ্গবাজার দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম বলেন, মোট ক্ষতিগ্রস্ত দোকানের তালিকা রয়েছে ২,৯৬১ জনের। নিচতলা, দোতলা এবং তিনতলা- সবাই চৌকি বসানোর জায়গা পাবেন।
"যাদের নিচে একাধিক দোকান ছিল তারাও একটি চৌকির জায়গা পাবেন, তবে একের অধিক কেউ দোকান পাবেন না এবং আগের দোকানের জায়গার তুলনায় বর্তমানের জায়গা একটু কম হবে," বলেন তিনি।
বুধবার বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের নিচতলায় অস্থায়ী দোকানের উদ্বোধন করবেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস।
জহিরুল ইসলাম বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য মানুষের দেওয়া অনুদানের ২ কোটি ১২ লাখ টাকা মেয়রের উপস্থিতিতে সকল ব্যবসায়ীদের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করা হবে।
অস্থায়ী দোকান বসানোর প্রস্তুতি
অগ্নিকাণ্ডের পরে বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা আর্জি জানিয়েছিলেন, চৌকি বিছিয়ে হলেও যেন তাদেরকে ঈদের মৌসুমে ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া হয়।
ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান প্রকৌশলী সালেহ আহম্মেদ এর তত্ত্বাবধানে, কর্পোরেশন গঠিত তদন্ত কমিটির সার্বিক সহযোগিতায় অঞ্চল-১ এর আঞ্চলিক নির্বাহী প্রকৌশলী মিঠুন চন্দ্র শীলের নেতৃত্বে অগ্নিকাণ্ডস্থল পরিষ্কার করে দোকান বসানর উপযোগী করা হয়েছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, বঙ্গবাজারের ১.৭৯ একর জায়গা জুড়ে বালি ও ইট বিছানো হবে। ইতোমধ্যেই সেখানে ৪০ গাড়ি বালি ফেলা হয়েছে এবং প্রায় ৯০ হাজার ইট বিছানো হয়েছে। পুরো এলাকায় প্রায় ২.৫ লক্ষ ইট বিছানো এবং প্রায় ১৫০ গাড়ি বালি ফেলা হবে জানা গেছে।
এছাড়াও, অগ্নিকাণ্ডস্থল হতে বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। কর্পোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. হায়দার আলীর নেতৃত্ব এ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
অগ্নিকাণ্ডস্থল হতে এখন পর্যন্ত ১,০৬০ টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বঙ্গবাজারে ব্যবসায়ীদের হাতাহাতি
বঙ্গবাজারের আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত দোকানের সংখ্যা, কমিটির কার্যক্রম ও এক কমিটিকে বাদ দিয়ে আরেক কমিটির ভারপ্রাপ্তি নিয়ে প্রশ্ন তুললে ব্যবসায়ীদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।
মঙ্গলবার (১১ এপ্রিল) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির অস্থায়ী ক্যাম্পে এ ঘটনা ঘটে।
এসময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন। পরিস্থিতি বুঝে তিনি উঠে সরে দাঁড়ান। এরপর ব্যবসায়ীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ধাক্কাধাক্কি হয়।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, "আমাকে সরকারের পক্ষ থেকে ফান্ড রেইজ করার জন্য বলা হয়েছে, আমি সেই চেষ্টা করছি। সেজন্যই আজ আমার বঙ্গবাজারে যাওয়া। কিন্তু সেখানে গিয়ে খুবই বিরক্ত হয়েছি। ব্যবসায়ীদের মধ্যে কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব। তাদের কার্যক্রমে বিরক্ত হয়ে আমি ঘটনাস্থল ত্যাগ করি।"
তিনি বলেন, কারা ক্ষতিগ্রস্ত, কারা নতুন করে অ্যালোটমেন্ট পাবে তা ঠিক করবে সিটি কর্পোরেশন।
হাতাহাতি-হট্টগোলের কারণ জানতে চাইলে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. নাজমুল হৃদা বলেন, এখানে আগুনের ঘটনায় ২,৯৬১ জন ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কোনো দোকান অক্ষত ছিল না। নিচতলা, দোতলা, তিনতলার কিছুই অবশিষ্ট নেই। কিন্তু এখন কেউ কেউ এসে বলা শুরু করল, এখানে নাকি ২৬০০ দোকান। বাকি দোকান নাকি ঘাপলা। এটি শুনে ক্ষতিগ্রস্ত দোকানিরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ধাওয়া হট্টগোলের সৃষ্টি হয়।
তিনি বলেন, "তালিকায় ২,৯৬১ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীর নাম এসেছে। সেই তালিকা আমরা সিটি কর্পোরেশনকে দিয়েছি।"
গত ৪ এপ্রিল ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বঙ্গবাজারের প্রায় ৫,০০০ দোকান পুড়ে যায় এবং কোটি কোটি টাকার মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে যায়।