টোকিও’তে সই হওয়া চুক্তির মধ্যে আছে দেড় হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র, গ্যাস অবকাঠামো
গ্যাস অবকাঠামো, হাসপাতাল, তথ্যপ্রযুক্তি খাতসহ ১,৫০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার সৌর ও গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তুলতে বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীদের সাথে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণে রাজি হয়েছে জাপানের শীর্ষস্থানীয় কিছু কোম্পানি।
বুধবার দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে জাপান ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কৌশলগত পর্যায়ে উন্নীত করার বিষয়ে ঐক্যমত্য হয়। এর পরের দিন– বৃহস্পতিবারেই সই হয়েছে মোট ১১টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ)। এরমধ্যে ৯টিতে গাঁটছড়া বেঁধেছেন বাংলাদেশ ও জাপানের বিনিয়োগকারীরা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরের তৃতীয় দিনে যেসব ব্যবসায়িক চুক্তি হয়েছে, তারমধ্যে অন্যতম হলো- চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ৭০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি অতি-সক্ষম কম্বাইন্ড সাইকেল গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ। কেপকো, একেএইচ পিপি প্রজেক্ট এবং ইতোচু বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ ও পরিচালনা করবে। ভবিষ্যতে এই কেন্দ্রে জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেনও ব্যবহার করা যাবে। কাজে লাগানো হবে বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে কানসাই এর দক্ষতা।
নতুন সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিনিয়োগ ও উন্নয়নের জন্য ডোরিন গ্রুপ ও মারুবেনির মধ্যে আরেকটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এশিয়ান এনটেক পাওয়ার কর্পোরেশন এবং মারুবেনি কর্পোরেশন যৌথভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মোট প্রত্যাশিত ৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পসহ নতুন বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগ ও উন্নয়ন করবে।
বাংলাদেশে যৌথভাবে ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার ভাসমান ও ভূমি-ভিত্তিক সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য আরেকটি সমঝোতায় সই করেছে পার্কার বাংলাদেশ লিমিটেড এবং সুমিতোমো কর্পোরেশন।
বাংলাদেশে গ্যাস সরবরাহ, এলএনজি সরবরাহ এবং সংরক্ষণের (মজুদ) জন্য জ্বালানি অবকাঠামো নির্মাণের জন্য জাপানের বৃহত্তম ইউটিলিটি পরিষেবা প্রদানকারী– জিরা'র সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছে সামিট গ্রুপ। উভয় পক্ষই দীর্ঘমেয়াদে সাশ্রয়ী এবং নির্ভরযোগ্য তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এবং অন্যান্য জ্বালানি সরবরাহের জন্য প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করবে। এজন্য বাংলাদেশে উপকূলীয় এবং অফ-শোর উভয় ধরনের রিগ্যাসিফিকেশন এবং মজুদের অবকাঠামো গড়ে তুলবে। .
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) যৌথভাবে জাপানের রাজধানী টোকিওতে 'জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সম্ভাবনা' শীর্ষক সম্মেলন আয়োজন করে, যার সাইডলাইনে এসব সমঝোতা স্মারক সই হয়।
তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে জাপানে অবস্থান করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি এ সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। সম্মেলনে জাপানের প্রায় ৪০০ ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
সম্মেলনে আসা বাংলাদেশি সাংবাদিকদের জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো)-র চিফ কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ইয়োজি আনডো বলেন, 'এই সম্মেলনের মাধ্যমে জাপানের অনেক ব্যবসায়ী বাংলাদেশের বাজার সম্পর্কে জানতে পারছে। ফলে ভবিষ্যতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ আরো বাড়ার সম্ভাবনা আছে'।
তিনি বলেন, বিপুল ভোক্তা থাকা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের বিষয়ে জাপানি কোম্পানিগুলোর আগ্রহ রয়েছে। বাংলাদেশের কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকারী শিল্পে এবং ভোগ্যপণ্যের বিষয়ে তাদের আগ্রহ আছে।
বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে (বিএসইজেড)- স্থানীয় বাজারের জন্য নিত্যপণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে ভূমি বিষয়ক আরেকটি চুক্তি হয়েছে বাংলাদেশের সেজ ও লায়ন কর্পোরেশনের মধ্যে।
পরবর্তী প্রজন্মের আইটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে বাংলাদেশের বিজেআইটির সাথে আরেকটি যৌথ উদ্যোগে সম্মত হয়েছে জাপানের মারুবেনি।
বাংলাদেশে জাপানের মানসম্মত একটি ডেন্টাল ল্যাবরেটরি গড়ে তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে আইচি হেলথ কেয়ার গ্রুপের সাথে অপর একটি সমঝোতায় সই করেছে মদিনা ডেন্টাল কোম্পানি।
ইরো ভিজিল এবং পাইপলাইন নামক দুটি সংস্থা বাংলাদেশে একটি নতুন সাইবার নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলবে। সাইবার নিরাপত্তার বিষয়ে ছাত্রদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা শেখাবে এই প্রতিষ্ঠান।
ব্যবসায়িক চুক্তি ছাড়াও উভয় দেশের শীর্ষ বেসরকারি খাত এবং বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এর একটিতে সই করেছে বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিআই) এবং জাপান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (জেসিসিআই)। অপরটিতে, সই করে বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এবং জাপানের ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস এজেন্সি।
আইসিটি শিল্পে সহযোগিতার লক্ষ্যে ১১তম সমঝোতাটি সই হয়েছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস এবং জাপান ইনফরমেশন টেকনোলজি সার্ভিসেস ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে।
আশাবাদী ব্যবসায়ীরা
ডিসিসিআই সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সমির সাত্তার মনে করেন, এই অংশীদারত্ব বাংলাদেশে আরো বেশি জাপানি বিনিয়োগ, উদ্ভাবনা, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও রপ্তানি বহুমুখীকরণকে উৎসাহিত করবে। এদেশের বিভিন্ন খাতে উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা বাড়াতে যৌথ উদ্যোগ এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরে বলিষ্ঠ উদ্যোগ নিতে জাপানের প্রতি অনুরোধ করেন তিনি।
উভয় দেশের অংশীদারত্ব - দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তির দিকেও উভয় দেশকে এগিয়ে নেবে। ফলে এলডিসি-পরবর্তী সময়ে জাপানের বাজারে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার হারালেও – তা কাটিয়ে ওঠার মতো ভালো অবস্থানে থাকবে।
জাপান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সমঝোতা সইয়ের পর এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসীম উদ্দিন বলেন, 'বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সার্বক্ষণিক অংশীদার ছিল জাপান'।
উভয় দেশের বাজার সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, 'প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে এই যাত্রায় – আমাদের উভয় দেশকে নতুন সম্ভাবনাগুলোকে খুঁজে বের করতে হবে এবং আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও সম্ভাবনাময় খাতকে কাজে লাগাতে হবে'।
রিজিওনাল কম্প্রেহেন্সিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপের মাধ্যমে উভয় দেশের ব্যবসায়িক উদ্যোগকে সমর্থন দেওয়া ও ব্যবসা পরিচালনাকে সহজ করতে যেসব আলোচনা চলছে – ২০২৬ সাল নাগাদ তা বন্ধুপ্রতীম দুই দেশের সম্পর্ককে আরো দৃঢ় কবে বলে আশাপ্রকাশ করেন তিনি।
ডোরিন পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড সিস্টেমস লিমিটেডের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা আফরোজ আলম জানান, ৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থান এখনো নির্ধারিত হয়নি। সমঝোতা স্মারকটি তিনি এখনও দেখেননি জানিয়ে বলেন, তাই বিনিয়োগ ও মালিকানার বিষয়াদি সম্পর্কে এই মুহূর্তে কিছু বলতে পারছি না।