প্লেটের আমিষের দাম আরও বাড়বে, খরায় ব্যাহত হয়েছে মাছের উৎপাদন
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এবং স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এবার সারাদেশের হ্যাচারিগুলোতে রেনু ও মাছের পোনার উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
অন্যদিকে, সারাদেশে পুকুর-খাল বিলে পানি না থাকায় যেটুকু পোনা উৎপাদন হচ্ছে, সেটুকুও চাষ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে চলতি বছর মাছের উৎপাদন সংকটে পড়েছে।
মৎস অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, মার্চ মাস থেকে আগস্ট পর্যন্ত রেণু ও পোনা উৎপাদনের ভরা মৌসুম। কিন্তু গত দুইমাস (মার্চ-এপ্রিল) ধরে বয়ে যাওয়া তীব্র তাপপ্রবাহে দেশজুড়ে হ্যাচারি ও প্রাকৃতিক উৎসে মাছের ডিম উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি বা তার কাছাকাছি থাকলে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত রেনু নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
কৃত্রিমভাবে মাছের পোনা উৎপাদনে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এলাকা যশোর। এ অঞ্চলে প্রতিবছর এক লাখ ২০ হাজার কেজি বিভিন্ন মাছের পোনা উৎপাদন হয়, যেটি এবার কমিয়ে ১ লাখ কেজিতে নামিয়ে আনা হয়েছে।
যশোরের চাঁচড়া মৎস্যপল্লীর ৩৪টি হ্যাচারিতে রেণু উৎপাদন হয়, যেখানে এ বছর উৎপাদনে আছে মাত্র ২৫টি। এই হ্যাচারিগুলোও গত দুই মাস বন্ধ ছিল, এখন সীমিত পরিসরে উৎপাদন চলছে বলে জানা যায়।
রেণুপোণা উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোভিড মহামারি থেকে শুরু হওয়া সংকট এখনো কাটেনি। এরমধ্যেই কম বৃষ্টিপাত, বাড়তি তাপমাত্রার বড় প্রভাব পড়তে শুরু করেছে হ্যাচারিতে। এছাড়া শ্রমিক সংকট এবং বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে হ্যাচারিগুলোর খরচও বেড়েছে; কমেছে উৎপাদন।
যশোর জেলা মৎস্য হ্যাচারি মালিক সমিতির সভাপতি ও ফাতিমা হ্যাচারির স্বত্ত্বাধিকারী ফিরোজ খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, গত দুই মাসে প্রচণ্ড গরমের কারণে রেনু-পোনার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনা হয়েছে। পুকুরগুলো শুকনো থাকায় পোনার চাহিদাও কম।
যশোর জেলা মৎস্য অফিসের সহকারী পরিচালক মাহবুবুর রহমান বলেন, এবার তাপদাহের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। গরমে ডিম উৎপাদন করা যায়না। ডিম না হলে পোনাও হবে না। ফলে অনেক হ্যাচারি বন্ধ করে রেখেছে।
একই অবস্থা ময়মনসিংহেও। অতিরিক্ত তাপমাত্রা, প্রাকৃতিক পানির অভাব ও উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় সেখানকার ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ হ্যাচারি বন্ধ হয়ে গেছে।
হ্যাচারি মালিকদের দেওয়া তথ্য বলছে, রেনু উৎপাদন করে পোনা তৈরির জন্য যে পুকুরে রাখতে হয়, তার পানির উচ্চতা ২.৫ থকে ৩ ফুট থাকা প্রয়োজন, আর সেখানকার জুতসই সর্বোচ্চ তামপাত্রা ২৮ থেকে ৩০ ডিগ্রি। তাপমাত্রা এরচেয়ে বেশি হল রেনু ও পোনা উৎপাদন দুটোই ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
এদিকে, পুকুরে পানি না থাকায় পোনার দাম ও বিক্রি কমে গেছে।
গতবছর এই সময়ে প্রতিকেজি পাঙ্গাসের পোনা বিক্রি হয়েছে ১৭০-১৮০ টাকায়, যেটি এবার ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আকার ও মানভেদে তেলাপিয়ার পোনা ১-২ টাকা পিস, শিং মাছের পোনা ৫০-৮০ পয়সা, মাগুর ১-২ টাকা, রুইয়ের (বড় সাইজের পোনা) কেজি ২০০-২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার সততা মৎস হ্যাচারির মালিক মো. শফিক বলেন, "হ্যাচারির পুকুরগুলোয় প্রচুর পানি দরকার হয়, কারণ তাপমাত্রা বেশি থাকায় পানি দ্রুত শুকিয়ে যায়। প্রতিদিন প্রায় ১২-১৪ পর্যন্ত ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে, যার জন্য ৬ হাজার টাকার ডিজেল কিনতে হচ্ছে।
চিংড়ি চাষেও একই অবস্থা তৈরির খবর পাওয়া গেছে। সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি পরিবারই ঘেরে চিংড়ি চাষে জড়িত। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে চিংড়ির মৃত্যুহার বেড়ে গেছে। স্বাভাবিক সময়ে যেখানে ১০-১৫ শতাংশ চিংড়ির পোনা মারা যায়, সেখানে এবার মৃত্যুহার পৌঁছেছে ২৫-৩০ শতাংশে।
খুলনা এবং সাতক্ষীরার চিংড়ির হ্যাচারির মালিকরা জানান, অতি তাপমাত্রার কারণে পোস্ট লার্ভা (পিএল) উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের চিংড়ি ঘেরের মালিক আবু বরক সিদ্দিকী বলেন, "২৫ বিঘার ঘেরে মার্চে ৬০ হাজার পোনা ছেড়েছিলাম। এবারে বাড়তি তাপমাত্রার কারণে প্রায় ৩০ শতাংশ পোনাই ঠিকেনি।"
মৎস অধিদপ্তর বলছে, সারাদেশে হ্যাচারির সংখ্যা ১,০৫৬টি, যেখানে ১০৩টি সরকারের মালিকানায় চলছে। এই হ্যাচারিগুলোতে রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, গ্রাসকার্প, থাই-সরপুটি, মিরর কার্প, আইড়, তেলাপিয়া, শিং, মাগুর, কৈ, পাঙ্গাস, পাবদা, টেংরাসহ নানান পদের মাছের কৃত্রিম প্রজনন করা হয়। প্রতিবছর রেনু পোনা উৎপাদন হয় সাড়ে ৬ লাখ কেজির বেশি। এরমধ্যে প্রকৃতিক উৎস থেকে মাত্র ২,১০০ কেজির মত রেনু পাওয়া যায়। এই রেনু থেকে উৎপাদিত পোনাগুলোই সারাদেশে চাষ হয়। যে চাষের মাছে ভর করেই বাংলাদেশ বর্তমানে মাছের উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
মৎস অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে ৪৬ লাখ টন মাছের উৎপাদনে ২৬ লাখ টনের বেশিই আসে চাষের মাছ থেকে। গত এক দশকে এই চাষের মাছ বাংলাদেশের মৎস খাতকে একটি নির্ভরতার জায়গায় নিয়ে গেছে।
তবে গত মাস দুয়েক ধরে বাজারে নদ-নদী ও চাষের মাছের সংকটের কারণে সরবরাহ কমেছে। যে কারণে সব ধরনের মাছই বেশি দামে কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের।
মৎস অধিদপ্তর বলছে, চলতি মাসের মধ্যে যদি টানা কয়েকদিন বৃষ্টিপাত হয়, তাহলে প্রজননে গতি আসবে। একইসঙ্গে, পুকুরে পানি পেলে চাষীরাও পোনা কিনতে শুরু করবে। কারণ প্রান্তিক চাষীরা পুকুরে প্রাকৃতিক পানি না পেলে মাছ চাষ করে না।
মৎস অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কেএইচ মাহবুবুল হক টিবিএসকে বলেন, "এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মাছের গ্রোথ সবচেয়ে বেশি হয়। এরপরে গিয়ে গ্রোথ পাওয়া যায় না। এই সময়টায় মাছের চাষ স্বাভাবিক না থাকলে মোট উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।"
হালদায় কমেছে ডিম উৎপাদন
বৃষ্টিপাতের অভাব এবং বাড়তি তাপমাত্রার কারণে দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস প্রজনন কেন্দ্র চট্টগ্রামের হালদা নদীতেও মাছের ডিম পাওয়া যাচ্ছে না।
গবেষক ড.মো. শফিকুল ইসলামের মতে, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট উচ্চ তাপমাত্রা এবং পানিতে লবণাক্ততা বাড়তে থাকায় মা মাছের প্রজননের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। হালাদায় কার্প-জাতীয় মাছের প্রজনন চক্রের সময় বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং হ্রাস পাচ্ছে প্রজনন ক্ষমতা। ফলে ক্রমাগত ডিম উৎপাদন কমে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া টিবিএসকে বলেন, "পানির উষ্ণতা বেশি থাকার কারণে নদীতে ভৌত-রাসায়নিক ফ্যাক্টরগুলো সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে মা মাছ ডিম ছাড়ছে না।"
আবহাওয়ার পূর্বাভাসেও নেই ভালো খবর
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, গত বছরের মত এবারও স্বাভাবিকের তুলনায় বৃষ্টিপাত কম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এল নিনো পরিস্থিতির কারণে বৃষ্টিপাত কম হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
কানাডার সাসকাচোয়ান ইউনিভার্সিটির আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ টিবিএসকে বলেন, "যে বছরগুলোতে এল নিনো কন্ডিশন তৈরি হয়, সে বছরে বৃষ্টিপাত কম হয় এবং খরার প্রবণতাও বেড়ে যায়। এবারও বিভিন্ন আবহাওয়ার পূর্বাভাস মডেলে এল নিনো কন্ডিশন তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ৮০-৯০ ভাগ।"
ইউরোপীয় ইউনিয়নের আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ সংস্থার পূর্বাভাসের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, "বাংলাদেশে মে, জুন, জুলাই-এই তিন মাসে ২০-৩০ শতাংশ বৃষ্টিপাত কম হতে পারে। তবে আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবরে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হবে।"
এছাড়া বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) এক সতর্কবার্তায় বলছে, আগামী পাঁচ বছর এ যাবৎকালের সবচেয়ে উঞ্চ সময় পার করতে পারে পৃথিবী।
- প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের চট্টগ্রাম প্রতিনিধি আবু আজাদ ও যশোরের মনোয়ার আহমেদ।