ট্রেন দুর্ঘটনা: নাম না জানা ভারতীয়দের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালো বাংলাদেশি পরিবার
শুক্রবার (২ জুন) রাতে ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের বালাসোরে তিনটি ট্রেনের সংঘর্ষে মারাত্মক এক দুর্ঘটনায় অন্তত ২৮৮ জন নিহত এবং ৮৫০ জনেরও বেশি আহত হয়েছে। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর খবরে বলা হয়েছে, গত তিন দশকের মধ্যে এটিই দেশটিতে সবচেয়ে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা।
দুর্ঘটনায় চেন্নাইগামী শালিমার-চেন্নাই সেন্ট্রাল করমণ্ডল এক্সপ্রেস ট্রেন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর কয়েকটি বগি লাইনচ্যুত হয়। আর এই ট্রেনেই স্ত্রী-পুত্রসহ সেদিন ছিলেন বাংলাদেশের হাবিবুর রহমান (৩৮)। এটা ছিল ভারতে তাদের প্রথম সফর।
পাঁচ বছরের ছেলেকে কোলে নিয়ে হাবিবুররা ছিলেন এস-৪ বগিতে। দুর্ঘটনার মুহূর্তে তাদের বগিটি একপ্রকার উপড়ে যায়। এক হাতে ছেলেকে নিয়ে হাবিবুর কোনোমতে বগি থেকে বেরোতে সক্ষম হন।
তখনও জানেন না স্ত্রীর ভাগ্যে কী ঘটেছে!
পরে এক অপরিচিত ভারতীয় নাগরিককে অনুরোধ করেন, তার ছেলেটিকে দেখে রাখতে। এরপর খুঁজতে থাকেন স্ত্রীকে।
প্রথমে স্ত্রী চামেলীর নাম ধরে চিৎকার করতে থাকেন হাবিবুর। খানিকপরে আকাশের দিকে মুখ করে থাকা উলটানো বগির ভেতর অচেতন স্ত্রীকে খুঁজে পান তিনি।
আরেকজন অপরিচিত ব্যক্তি তার স্ত্রীকে সেখান থেকে বের করে আনেন। চারপাশে তখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বহু মৃতদেহ।
আগে থেকে পরিচয় না থাকার পরেও যেভাবে ভারতীয়রা সেদিন দুর্ঘটনাস্থলে হাবিবুর এবং তার পরিবারের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাতে কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠেছে বগুড়ার দরিয়াপুরের এই বাসিন্দার মন।
সেদিনের বর্ণনা জানুন হাবিবুরের মুখেই-
এটা ছিল ভারতে আমার প্রথম সফর। ছেলে রাহি সাদিকের চিকিৎসার জন্য ভারতের ভেলোরে যাচ্ছিলাম। রাহি আমার কোলেই ছিল, স্ত্রী চামেলী ছিল পাশে।
হঠাৎ প্রচণ্ড এক ঝাঁকুনিতে বগির সমস্ত আলো নিভে গেল।
ভিতরে অনেক হইচই ছিল আর মনে হচ্ছিল যেন, পৃথিবীটা উল্টে যাচ্ছে! বুঝতে পারলাম, আমাদের ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বিকট শব্দে ট্রেন থেমে গেল। চারপাশে সাহায্যের জন্য আকুতি ভেসে আসছিল। অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না, তার উপর চারপাশ থেকে মানুষ একে অপরের এসে পড়তে লাগল। এর মধ্যে ছেলে যেন আমার হাত থেকে ছিটকে না যায়, সেটা নিশ্চিত করছিলাম।
সন্তানকে আঁকড়ে ধরে কোনোমতে কোচ থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হলাম। বেরিয়ে প্রথম যার সাথে দেখা হয়, তাকেই অনুরোধ করি আমার ছেলেটাকে একটু দেখে রাখতে। তিনি নিজেও কিন্তু আমার মতোই তখন ট্রেনের ভিতর থেকে বেরোন। অপরিচিত হওয়া সত্ত্বেও সেই ব্যক্তি সে মুহূর্তে আমার ছেলেকে দেখে রাখতে রাজি হয়ে যান।
আমি কম্পার্টমেন্টের ভিতরে ফিরে যাই; রক্ত, মানুষের আর্তনাদে সেখানে তখন নারকীয় দশা। সিটে ফিরে গিয়ে আমি একটি ব্যাগ পাই যেটায় আমাদের পাসপোর্ট সহ প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র রাখা ছিল।
চামেলিকে তখনও দেখিনি।
আমি ওর নাম ধরে চিৎকার করে খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু কোনো সাড়া পাচ্ছিলাম না।
খুঁজতে খুঁজতেই বগি থেকে বেরিয়ে চামেলির ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। কোনো এক অপরিচিত ব্যক্তি তাকে মৃতদেহের স্তূপের মধ্য থেকে টেনে বের করে উল্টে যাওয়া বগির পাশে শুইয়ে রেখে যায়।
এরপর কলকাতাগামী আরেকজন অপরিচিত যাত্রী আমাদেরকে তার গাড়িতে লিফট দেন এবং অর্থ সহায়তাও করেন। রোববার সকালে পেট্রাপোল বর্ডারে বাসে উঠে আমরা দেশে পৌঁছাই।
এই নাম না জানা মানুষগুলোকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের ভাষা আমার জানা নেই, বলেন হাবিবুর।