ইউক্রেনের বাঁধ বিপর্যয়ে গমের বৈশ্বিক বাজারে প্রভাব
আন্তর্জাতিক বাজারে সপ্তাহখানেকের বেশি সময় ধরে গমের দাম বাড়তে শুরু করেছে এবং এ সময়ের মধ্যে প্রতি বুশেল (২৫ কেজি) গমের দাম ৩.৩২% বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিস্থিতি সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের আমদানিকে আরও বেশি ব্যয়বহুল করে তুলতে পারে।
জানা যায়, যুদ্ধের ব্যাপকতা বেড়ে যাওয়ার কারণে রাশিয়া-ইউক্রেন শস্য চুক্তির নবায়নকেও ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে, যা বৈশ্বিক সরবরাহ পরিস্থিতিকে আরও দুর্বল করে দিতে পারে। যুদ্ধের এই খারাপ পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলের একটি বাঁধ ধ্বংস হওয়ায় ঐ অঞ্চলের শস্যের উৎপাদন ও সরবরাহ পরিস্থিতিকে দুর্বল করে দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটেই আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম বাড়তে শুরু করেছে।
দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের তথ্য বলছে, ১ থেকে ৯ জুন সময়কালে প্রতি বুশেল গমের দাম ৬.১১ মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ৬.৩১ মার্কিন ডলারে উঠেছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, বেশ কিছুদিন ধরেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপকতা বেড়েছে। যুদ্ধে গত ৬ জুন দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের একটি ড্যাম (বাঁধ) ধ্বংস হয়েছে। এতে করে কিছু অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এবং এই পানির কারণে প্রায় ৫ লাখ হেক্টর জমির চাষাবাদ ব্যাহত হবে বলে জানিয়েছে কিয়েভ। শুধু যে ফসল চাষাবাদ ক্ষতির মুখে পড়বে তাই নয়, এ পরিস্থিতি দেশটির সববরাহ চেইনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এই কারণে ক'দিন ধরেই বিশ্ববাজারে গমের দাম বাড়তে শুরু করেছে।
স্থানীয় আমদানিকারকরা জানান, ডলার সংকটের কারণে দেশে এখনো আমদানি পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। এই পরিস্থিতিতে আবারও যদি ইউক্রেনের সরবরাহ পরিস্থিতির অবনতি ঘটে, তাহলে সেটার চাপ বিশ্ববাজারে পড়বেই। একদিকে বিশ্ববাজারে গমের সরবরাহ কমবে, অন্যদিকে দাম বেড়ে যাবে। তখন এটা বাংলাদেশের সংগ্রহকারীদের জন্য আরও কষ্টকর হয়ে পড়বে।
বসুন্ধরা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার রেদওয়ানুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ড্যাম ও যুদ্ধের কারণে আবারও যদি ইউক্রেনের সরবরাহ পরিস্থিতি দুর্বল হয় তাহলে বিশ্ববাজারে গমের দাম বেড়ে যেতে পারে, যা আমাদেরকে চাপে ফেলবে।"
তিনি বলেন, "ইতোমধ্যেই আমরা ডলার সংকটে গম সরবরাহ নিয়ে চাপের মধ্যে রয়েছি।"
দেশে সাধারণত সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে গম আমদানি হয়। সরকারিভাবে খাদ্য অধিদপ্তর গম আমদানি করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "আপাতত সরকারের গমের মজুত ভালো রয়েছে, যে কারণে এখনই আমদানির চিন্তা করতে হচ্ছে না। তবে গত বছর জি-টু-জি চুক্তিতে যেভাবে গম আমদানি হয়েছে, আগামী অর্থবছরেও সেভাবে গম আমদানির পরিকল্পনা করা হচ্ছে।"
তিনি বলেন, "বিশ্ববাজারে দাম বেশি হলে সরকারি পর্যায়েও আমদানির খরচটা বাড়বে।"
স্থানীয় আমদানিকারক ও সরবরাহকারীরা জানান, বর্তমান সময়ে দেশের বাজারে গ্রীষ্মকালীন ফলের সরবরাহ প্রচুর। এই সময়ে মানুষ নাস্তার মেন্যুতে ফলমূলই রাখে বেশি। যে কারণে গম ও গম থেকে তৈরি পণ্যের চাহিদা কমে যায়। কিন্তু বছর দুয়েক ধরে যেহেতু আমদানি কম, সে কারণে চাহিদা কম থাকলেও সরবরাহ বৃদ্ধির একটা চেষ্টা আমদানিকারকদের মধ্যে রয়েছে। কারণ প্রতি বছর ৬৫-৭০ লাখ টন গমের যে চাহিদা রয়েছে, তার বেশিরভাগই আমদানি করতে হয়। যা গত দুই বছর ধরে একেবারেই তলানিতে নেমে গেছে।
এদিকে গত ১৮ মে শেষ হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন শস্য চুক্তির মেয়াদ। এই চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির কথা শোনা গেলেও এখনো পর্যন্ত চুক্তিটি নবায়নের ঘোষণা আসেনি। এটাও গমের আন্তর্জাতিক বাজারের সরবরাহ পরিস্থিতিকে একটা চাপের মধ্যে রেখেছে, কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন গমের বৈশ্বিক বৃহৎ সরবরাহকারী দুটি দেশ।
গত বছরের জুলাইয়ে জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় এ শস্য চুক্তি সই হয়েছিল। প্রথমবার ১২০ দিন এবং দ্বিতীয় দফায় এটি ৬০ দিনের জন্য বাড়ানো হয়। রাশিয়া চুক্তি নবায়নে ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও তারা ইউক্রেনে আক্রমনের তীব্রতা বাড়িয়েছে এবং ইউক্রেনও পাল্টা প্রতিরোধ ও আক্রমণ শুরু করেছে। যে কারণে যুদ্ধের তীব্রতা বাড়ছে।
এসব কারণেই বিশ্ববাজারে বাড়ছে গমের দাম। সম্প্রতি প্রকাশিত ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাঁধ ধ্বংস এবং অ্যামোনিয়া পাইপলাইনের ক্ষতির কারণে ১ জুনের পর থেকে টানা ৫ দিন গমের দাম বৃদ্ধি পায়।
ইউক্রেনের দাবি, বাঁধটি রাশিয়াই উড়িয়েছে। যদিও এর অবস্থান শস্য চুক্তির আওতায় থাকা ইউক্রেনের তিন বন্দর থেকে কিছুটা দূরে, তবু এর ফলে যে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তা মানুষ, পরিবহন এবং সরবরাহের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করবে। তবে রাশিয়া এর কোনো দায় এখনও নেয়নি।
জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে ইউক্রেন থেকে ৮.৭ শতাংশ এবং রাশিয়া থেকে ২.১ শতাংশ গম আমদানি হয়। এ সময়ে ভারত থেকে আমদানি হয় ৬২.৩ শতাংশ গম।
তবে যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী যখন খাদ্যসংকটের আশংকা করা হয়, তখন ভারত নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তায় গমের রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। ডলার ও আমদানির উৎস সংকটে বিপদে পড়ে বাংলাদেশ। ডলার সংকট না কাটলেও বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি আমদানিকারকদের বাধ্য হয়েই নির্ভরতার জায়গা তৈরি হয় রাশিয়া-ইউক্রেনের উপর। এই সরবরাহ চেইনে আবারও সমস্যা তৈরি হলে দেশের আমদানি পরিস্থিতি আবারও ঝুঁকিতে পড়বে বলে মনে করছেন স্থানীয় আমদানিকারকরা। কারণ ভারত থেকে এখনো গম আমদানি হচ্ছে না।