পঞ্চাশের বেশি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে লাম্পি স্কিন, এগ্রো খাতে বিপর্যয়ের শঙ্কা
'আমরা গরুগুলোকে পরিবারের সদস্যদের মতোই লালনপালন করি। কিন্তু আদরের সেই গরুগুলো যখন একে একে মারা গেলো, তখন মনে হচ্ছিলো যেন নিজ স্বজনদের হারাচ্ছি। গত দুই সপ্তাহে লাম্পি স্কিন রোগে সাতটি বাছুর এবং তিনটি গাভী মারা গেছে। বর্তমানে আরও পাঁচটি বাছুর আক্রান্ত। যে স্বপ্ন নিয়ে খামার করেছিলাম; এক লাম্পিতেই তা ভেঙ্গে গেছে।'
সোমবার চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার চরলক্ষা ইউনিয়নে নিজ খামারে দাঁড়িয়ে এসব বলছিলেন 'ওজি অ্যাগ্রো' এর স্বত্বাধিকারী তানভীর কালাম।
বোয়ালখালী উপজেলার কৃষাণী ছালেহা বেগম বলেন, 'অভাবের সংসারে কিছু রোজগারের আশায় এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে একটি গাভি কিনেছিলাম। কিছুদিন পরই এটি বাছুরের জন্ম দিত। এর মধ্যে লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত হয় গাভিটি। স্থানীয় একাধিক পশু চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসা করিয়েছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। ১৫ দিন ভুগে মারা যায় গরুটি।'
কৃষাণী ছালেহা বা তরুণ উদ্যোক্তা তানভীর নন শুধু। চট্টগ্রামসহ সারা দেশে গবাদি পশুর শরীরে লাম্পি স্কিন (এলএসডি) নামে একটি ভাইরাস জনিত রোগ মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিদিনই দেশের নতুন নতুন এলাকার গবাদিপশু এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আক্রান্ত হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে আরও লাখ লাখ গবাদিপশু।
লাম্পি স্কিনের প্রাদুর্ভাবের কারণে গরু খামারিরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন; উৎপাদন কমছে দুধের। সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতির শঙ্কা হাজার কোটি টাকা। যা এ খাতের জন্য অশনিসংকেত, বলছেন ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা।
বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি ইমরান হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'প্রায় ৫০টি জেলায় লাম্পি স্কিন রোগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। দেশে বর্তমানে গরুর সংখ্যা ২ কোটির বেশি। এর মধ্যে এলাকাভেদে ৫ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত গরু লাম্পি স্কিন রোগে ভুগছে; অন্তত ১০ হাজার গরু-বাছুর এই রোগে মারা গেছে। খামার মালিকদের ক্ষতি পাঁচ থেকে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত ছাড়িয়ে গেছে। প্রান্তিক পর্যায়ের গৃহস্থরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন।'
সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার খামারি রিশাদ মোরশেদ বলেন, 'আমার ব্রাহমা প্রজাতির একটি বাছুর ছিলো। প্রায় দেড় লাখ টাকা দামের বাছুরটি লাম্পিতে মারা গেছে; আক্রান্ত আরো পাঁচ গরু। শুধু আমার খামার নয়, বেলকুচি উপজেলায় বাড়িতে বাড়িতে এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে।'
সিরাজগঞ্জ ছাড়াও মেহেরপুর, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, খুলনা, কুষ্টিয়াসহ সীমান্তবর্তী প্রায় সব জেলাতেই এই রোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
লাম্পি স্কিনের প্রাদুর্ভাবে সারাদেশের খামারি ও গৃহস্থরা যখন দিশেহারা, তখন প্রশ্ন উঠছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভূমিকা নিয়ে। জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে খামারিদের সংগঠনগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশে মজুদ গরুর প্রায় ১৫ শতাংশ এই মুহুর্তে লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত। তবে এ নিয়ে পর্যাপ্ত কোনো তথ্য নেই প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কাছে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও এ মুহুর্তে দেশে কতটি গরু লাম্পি স্কিনে আক্রান্ত বা মারা গেছে সে তথ্য জানাতে পারেনি।
তবে রংপুরের প্রাণিসম্পদ বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা ডা. মো. আবদুল হাই জানান, তারা এ পর্যন্ত ১০ হাজার গরু আক্রান্তের খবর পেয়েছেন। এ হিসেব শুধু হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে নিয়ে আসা পশুর।
বিডিএফএ'র সভাপতি ইমরান হোসেন অভিযোগ করেন, ২০১৯ সালে দেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব শুরু হলেও গত দুই বছর রোগটি নিয়ন্ত্রণে ছিলো। কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারিতে ভ্যাকসিন আমদানি নিষিদ্ধ করে সরকার। এই সময়ে সারা দেশে রোগটি ছড়িয়ে গেছে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এই মহামারী রোধে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই।
এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (সম্প্রসারণ) ড. মোঃ শাহিনূর আলম বলেন, 'রংপুর-চট্টগ্রামসহ বিচ্ছিন্ন কিছু অঞ্চলে লাম্পি স্কিন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। তবে কত সংখ্যক পশু এ রোগে আক্রান্ত তা এই মুহুর্তে বলা যাচ্ছে না। সরকার ৫০ লাখ ভায়াল ভ্যাকসিন আমদানির অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু যারা আমদানির অনুমতি পেয়েছিলো, তারা সময়মত সেটি আমদানি না করায় এই সংকট দেখা দিয়েছে।'
দ্রুত অবনতি হচ্ছে চট্টগ্রামের পরিস্থিতি
প্রাণীবিজ্ঞানীরা জানান, ২০১৬ সালের দিকে প্রথম দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ঝিনাইদহ, যশোর জেলায় গরুর মধ্যে এলএসডি শনাক্ত হয়। ভারত থেকে অবৈধভাবে নিয়ে আসা গরু থেকে দেশের গরুর মধ্যে এই রোগ ছড়িয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
২০১৯ সালে চট্টগ্রামে ২ লাখ ৬০ হাজার গরু এই রোগে আক্রান্ত হয়। চলতি বছর তা আরও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় ডেইরি ফার্মারস এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ওমর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'চট্টগ্রামে পাঁচ হাজারের বেশি খামার ও গৃহস্থের গোয়ালে ২০ লাখ গরু রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ গরু বর্তমানে লাম্পি স্কিনে আক্রান্ত। গত তিন মাসে অন্তত ৮০০ গরু এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।'
তবে চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আলমগীর জানান, তাদের হিসেবে জেলায় লাম্পি স্কিনে আক্রান্ত পশুর সংখ্য ২০ হাজার এবং মারা গেছে শতাধিক গরু।
প্রান্তিক খামারিদের অভিযোগ, প্রাণিসম্পদ অফিসের চিকিৎসকদের ডাকলে সাড়া দেন না। আর এলেও তাদের বড় অঙ্কের ফি দিতে হয়। নিরুপায় হয়ে তারা গ্রামের পশু চিকিৎসকদের মাধ্যমে চিকিৎসা করাচ্ছেন। এতে অনেক ক্ষেত্রে বিপত্তি ঘটছে।
ডেইরি খাতে ক্ষতি হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কা
এগ্রো খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছে, লাম্পি স্কিনের কারণে খামারিরা তিনধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছেন। প্রথমত, আক্রান্ত পশুর জন্য অতিরিক্ত ব্যয়। এরপরও অনেক গরু মারা যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, লাম্পি আক্রান্ত পশু সুস্থ হলেও তার গ্রোথ বা বৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। তৃতীয়ত, কমছে দুধের উৎপাদন।
মোহাম্মদ ওমর বলেন, 'লাম্পি স্কিনে আক্রান্ত গরুর ছয় থেকে এক বছর পর্যন্ত অতিরিক্ত লালনপালন করতে হয়। যে গরু দৈনিক ২০ কেজি দুধ দেয়, লাম্পিতে আক্রান্ত হলে তা মাত্র ৫ কেজিতে নেমে আসে। এছাড়া পাঁচ কেজি খাবারে যে গরুর ৮০০ গ্রাম গ্রোথ হয়, সেটি ঠেকে ২০০ গ্রামে।'
চট্টগ্রামের এগ্রো খাতের অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান 'ওয়েল এগ্রো'। এ খামারে ২৫০টি গরু থেকে প্রতিদিন ১ টন দুধ উৎপাদন হয়।
প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী বিজিএমইএ'র সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'আশেপাশের বিভিন্ন খামারে ইতোমধ্যেই লাম্পি স্কিন আঘাত করেছে। এটি আমাদের শঙ্কায় ফেলে দিয়েছে।'
এফবিসিসিআই'র ডেইরি স্ট্যান্ডিং কমিটির প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক ও চৌধুরী এগ্রোর স্বত্বাধিকারী সাগর চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, 'লাম্পি স্কিন শুধুমাত্র খামারিদের অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছেনা, এটি আমাদের মানসিকভাবেও ভেঙ্গে দিচ্ছে। সরকার দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে এগ্রো খাতে বড় বিপর্যয় ঘটে যাবে।'
তিনি অভিযোগ করে বলেন, 'কোরবানিকে কেন্দ্র করে বর্ডার শিথিল থাকায় ভারত-মিয়ানমার থেকে প্রচুর গরু এসেছে। আশঙ্কা করছি এ কারণেই সারাদেশ রোগটি ছড়িয়েছে।'
লাম্পি স্কিন যেভাবে ছড়ায়, করণীয় কী
প্রাণিবিজ্ঞানীরা বলছেন, এলএসডি গরুর একধরনের ভাইরাসজনিত চর্মরোগ। বিভিন্ন কীটপতঙ্গ যেমন মশা ও বিশেষ প্রজাতির মাছি ইত্যাদির মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়। এ ধরনের কীটপতঙ্গ আক্রান্ত গরুকে দংশন করার পর অন্য একটি সুস্থ গরুকে দংশন করলে সেই গরুটিও আক্রান্ত হয়। আবার আক্রান্ত গরুর লালা খাবারে মেশে এবং খামার পরিচর্যাকারী ব্যক্তির কাপড়চোপড়ের মাধ্যমে ছড়াতে পারে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (সম্প্রসারণ) ড. মোঃ শাহিনূর আলম বলেন, 'এ রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হলো জ্বর। এরপর ত্বকের ওপরে জলবসন্তের মত ফোঁড়া হয়। সঠিক চিকিৎসা না হলে গরু দুর্বল হয়ে যায়। এ অবস্থায় গরুর মৃত্যুও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে লক্ষণ অনুযায়ী গরুর চিকিৎসা করতে হবে, তবে কোনোভাবেই এন্টিবায়োটিক দেওয়া যাবে না।'
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস ইউনিভার্সিটির মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ভেটেরিনারি পাবলিক হেলথ ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক ড. পরিতোষ কুমার বিশ্বাস বলেন, 'লাম্পি স্কিন রোগ প্রতিরোধে একমাত্র সমাধান হলো আগাম ভ্যাকসিন। দেশে তৈরী গোট ফক্স নামে একটি ভ্যাকসিন এ রোগ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও কয়েক ধরনের ভ্যাকসিন আমদানি করা হয়ে থাকে। ভ্যাকসিন ফ্রিজিং করার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করা না হলে সমস্যা হতে পারে।'
'দেশে গবাদিপশু খামারের সঙ্গে জড়িতদের প্রায় ৯৫ শতাংশই আর্থিকভাবে সচ্ছল নন। তাই প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উচিত ফ্রী ভ্যাকসিনাইজেশনের মাধ্যমে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আগেই পশুগুলো চিকিৎসার আওতায় আনা। পাশাপাশি খামারি ও গৃহস্থদের সচেতন করতে আলাদা প্রোগ্রাম নেওয়া যেতে পারে,' বলেন তিনি।