বন্যায় চট্টগ্রামের ৬৫ শতাংশ গ্রামীণ রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত
চট্টগ্রামের সাতকানিয়া বুড়িশ্চর সার্কুলার সড়কের গাটিয়াডাঙ্গা-দেওদিঘী মির্জাখিল সড়কটির অবস্থা খুবই শোচনীয়। সাম্প্রতিক বন্যায় রাস্তাটির প্রায় ৮ দশমিক ২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পুরোটাই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পানি নেমে গেলেও সড়কটির দুরবস্থার কারণে এ পথে চলাচলকারীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
একই অবস্থা চন্দনাইশ থেকে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা পর্যন্ত ভোমাং হাট-মংলার মুখ রাস্তার। দীর্ঘ ২০ কিলোমিটার রাস্তার প্রায় ১৫ কিলোমিটারই এবারের বন্যায় চলাচলের অনুপযোগী হয়ে গেছে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) চট্টগ্রাম কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, টানা বৃষ্টি ও বন্যায় চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলার ৮ হাজার ৬৪১ কিলোমিটার গ্রামীণ রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; যা জেলার মোট গ্রামীণ রাস্তার ৬৫ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৬২ কিলোমিটার রাস্তা। একেবারে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এমন সড়কের পরিমাণ ১৫৬ কিলোমিটার। বন্যায় আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ ৩২ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
এখন পর্যন্ত পাওয়া হিসেব অনুযায়ী, জেলার সাতকানিয়ায় সর্বোচ্চ ৬৭ কিলোমিটার রাস্তা গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, হাটহাজারীতে ৩৫ কিলোমিটার, লোহাগাড়া ২৪ কিলোমিটার, পটিয়ায় ১৩ কিলোমিটার, বাঁশখালীতে ৫৯ কিলোমিটার, বোয়ালখালীতে ৩৭ কিলোমিটার, আনোয়ারায় ৬ কিলোমিটার, রাঙ্গুনিয়ায় ৬২ কিলোমিটার, চন্দনাইশে ৮ কিলোমিটার, মিরসরাইতে ২৩ কিলোমিটার, সীতাকুণ্ডে ১৩ কিলোমিটার, রাউজানের ১০ কিলোমিটার এবং ফটিকছড়িতে ১ কিলোমিটার রাস্তা গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এছাড়া বন্যায় লোহাগাড়ায় সর্বোচ্চ ৮টি, হাটহাজারীতে ১টি, বোয়ালখালীতে ৩টি, চন্দনাইশে ১টি ব্রিজ কালভার্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সন্দ্বীপ ও কর্ণফুলি উপজেলার ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ পাওয়া যায়নি।
সাতকানিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান এম. এ মোতালেব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'উপজেলার একটি সড়কও অক্ষত নেই। ১৪টি সড়ক গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবারের বন্যায় পানির উচ্চতা যেমন বেশি ছিল, তেমনি পানিতে স্রোতও ছিল বেশি। এ কারণে ক্ষতিও বেশি হয়েছে।'
'বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের দুর্ভোগ সীমাহীন হয়ে উঠেছে। স্থানীয়দের অনেকে নিজ উদ্যোগে সড়ক মেরামত করে চলাফেরা করছেন। এসব সড়ক দ্রুত সংস্কার করা না হলে মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়বে।'
এলজিইডি চট্টগ্রাম কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী সুমন তালুকদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এর আগে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বন্যায় সড়কের এত বেশি ক্ষতি কখনো হয়নি। মূলত পাহাড়ি ঢলে অনেক স্থানে রাস্তা ছিঁড়ে গেছে। এছাড়া গ্রামীণ অনেক রাস্তা দশদিনে বেশি সময় পানিতে তলিয়ে ছিলো, এতে ক্ষতি বেড়েছে। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে রাস্তাগুলো চলাচল উপযোগী করার চেষ্টা করছি। পূর্ণাঙ্গভাবে সারাতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে।'
২৫০ কিলোমিটারের বেশি মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত
বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রাম-কক্সবাবাজার ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সহ জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা মহাসড়কের প্রায় ২৫০ কিলোমিটার এলাকা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা সড়ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কসহ উত্তর চট্টগ্রামে ৪১টি জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা মহাসড়কের ৩১টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার পরিমাণ প্রায় ১১৪ কিলোমিটার। এসব সড়ক সংস্কারে প্রাথমিকভাবে ১১ কোটি ও দীর্ঘমেয়াদে ২৯ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে।
জেলা সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা টিবিএসকে বলেন, 'বন্যায় মহাসড়কের অনেক স্থানে পটহোলস (গর্ত) তৈরী হয়েছে। সড়কের পেভমেন্ট ও প্রতিরক্ষামূলক বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আপাতত সড়ক চলাচল রাখতে সওজ ব্যবস্থা নিয়েছে। বড় ক্ষতি সারাতে অন্তত ২০-৩০ দিন সময় লাগবে।'
এদিকে বন্যায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের প্রায় ৫৭ কিলোমিটার অংশ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম অংশে প্রায় ২৫ কিলোমিটার এবং কক্সবাজার অংশে প্রায় ৩২ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সুমিন সিংহ টিবিএসকে জানান, 'ক্ষতির ব্যাপকতা এত বেশি, এখনো ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে আনুমানিক ২৫ কিলোমিটার সড়ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।'
কক্সবাজার জেলা সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহে আরেফীন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কক্সবাজারে মোট ৭০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় মহাসড়কের ৩২ কিলোমিটার, আঞ্চলিক ১৩ কিলোমিটার ও জেলা পর্যায়ে ২৫ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে প্রায় ১২ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।'
এর আগে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন জানায়, টানা বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে নগরীর অন্তত ৫০ কিলোমিটার নষ্ট হয়েছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুই কিলোমিটার ফুটপাত ও দুই কিলোমিটার ড্রেন। এসব সড়ক, ফুটপাত ও ড্রেন মেরামতে ব্যয় হবে অন্তত ৬০ কোটি টাকা।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ২৮ হাজার ৭০টি ঘরবাড়ি, ৩ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের দুর্যোগ ও ত্রাণ শাখার তথ্য অনুযায়ী, এবারের বন্যায় ২৮ হাজার ৭০টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে ১৮ হাজার ৮৮৫ ঘরবাড়ি আংশিক ও ৯ হাজার ১৮৫ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাতকানিয়া, চন্দনাইশ ও লোহাগাড়া উপজেলায়। সাতকানিয়ায় দুই হাজার ৪৭৯টি ঘর আংশিক ও নয় হাজার ১৮৫টি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। চন্দনাইশে চার হাজার ১২০টি ঘর আংশিক ও ৬ হাজার ৩৭৯টি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লোহাগাড়ায় ২৫০০ ঘর আংশিক ও দুই হাজার ঘর সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে।
এছাড়া চট্টগ্রামে তিন শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সাতকানিয়া উপজেলার প্রায় ৮৮ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি নেমে গেলেও শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যায়নি। বিষয়টি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্কে জানিয়েছেন জেলা শিক্ষা অফিসার উত্তম খীসা।