চবিতে শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতা শিথিল নিয়ে ক্ষোভ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ফিজিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড স্পোর্টস সায়েন্স বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতা শিথিল করে দ্বিতীয় শ্রেণি করা হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগে দীর্ঘদিনের রীতি পরিবর্তন করায় নানা প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া নির্দিষ্ট কাউকে সুবিধা দিতে এমন নিয়ম করা হয়েছে বলেও আলোচনা চলছে বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন সিন্ডিকেট সদস্য ও শিক্ষকরা।
২০১৮ সালে বিজ্ঞপ্তি দিয়েও যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় উক্ত বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়নি। বিষয়টিকে সামনে এনে গত ৪ মার্চ অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৪৩ তম সিন্ডিকেট সভায় আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল ফারুককে দায়িত্ব দিয়ে এক সদস্যের কমিটি করা হয়। গত ১৪ জুলাই অনুষ্ঠিত ৫৪৪ তম সিন্ডিকেট সভায় এ সংক্রান্ত একটি সুপারিশপত্র দাখিল করা হয়।
সেখানে বলা হয়েছে, 'পুরোনো ডিভিশন পদ্ধতিতে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের ক্ষেত্রে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রিতে কমপক্ষে দ্বিতীয় শ্রেণি থাকতে হবে। স্বীকৃত কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগসহ বিপিএড এবং এম.পি.এড ডিগ্রি থাকতে হবে। বিভাগে বর্তমানে কর্মরত উপরোক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মকর্তা যাদের ফিজিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড স্পোর্টস সায়েন্স বিভাগের বিভিন্ন তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক কোর্সে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে পাঠদানের অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদেরকে বর্তমান পদমর্যাদা ও অন্যান্য যোগ্যতাকে যথাযোগ্য পদে রূপান্তরপূর্বক নিয়োগ বা আত্মীকরণ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে তাদের বর্তমান বেতন স্কেল (গ্রেড) ও মূল বেতন ব্যক্তিগত স্কেল ও বেতন হিসেবে বহাল রাখা যেতে পারে।
তবে প্রভাষক পদে আবেদনে ক্ষেত্রে শিক্ষা জীবনের দুটি স্তরে প্রথম শ্রেণির কথা বলা হলেও নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। আত্মিকরণের মাধ্যমে শিক্ষক হিসেবে দ্বিতীয় শ্রেণী দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হলেও তারা বেতন-ভাতা পাবেন পূর্বের পদ ও স্কেল অনুযায়ী। ফলে কম যোগ্যতা দিয়েই অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা পাবেন তারা। সুপারিশে বলা হয়, "বিভাগ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক কোর্সে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে একাধিকক্রমে কমপক্ষে ৫ পাঠদানের অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী (এমফিল/পিএইচডি) রয়েছে কিন্তু শিক্ষা জীবনের যে কোন স্তরে দুটি প্রথম শ্রেণি/বিভাগ রয়েছে তারা প্রভাষক পদে আবেদনের জন্য যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবেন।
বিশ্বদ্যিালয়ের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে গ্রেডিং পদ্ধতিতে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের ক্ষেত্রে এসএসসি এবং এইচএসসি (সমমান) পরীক্ষায় আলাদাভাবে নূন্যতম জিপিএ ৩.০০ অথবা উক্ত দুটি পরীক্ষায় মোট নূন্যতম ৭.০০ রাখা হয়েছে। অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রিতে পুরনো গ্রেডিং পদ্ধতিতে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সিজিপিএ একটিতে ৩.৫০ ও অন্যটিতে ৩.৩০ অথবা বর্তমান পদ্ধতিতে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের ক্ষেত্রে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তরের একটিতে ন্যূনতম সিজিপিএ ৩.৫০ এবং অন্যটিতে ৩.৪০ রাখা হয়।
বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষক নিয়োগ শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. হাছান মিয়া টিবিএসকে বলেন, ২০১৮ সালে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে চার-পাঁচ জন প্রার্থী আবেদন করেছিলেন। কিন্তু তাদের মাস্টার্সের রেজাল্ট প্রকাশ হতে হতে আমাদের আবেদনের সময় শেষ হয়ে যায়। ফলে আর শিক্ষক নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি। এরপরে আর কোনো বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি।
কার্যবিবরণীতে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন, ক্ষোভ শিক্ষকদের:
সিন্ডিকেট সদস্যরা জানিয়েছেন, যোগ্যতা শিথিলের এ সুপারিশ ৫৪৪ তম সিন্ডিকেটে উত্থাপিত হলেও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। কিন্তু কার্যবিবরণীতে যোগ্যতা শিথিলের এ সুপারিশকে সিদ্ধান্ত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নিয়মানুযায়ী সিন্ডিকেট সভার ১৫ দিনের মধ্যে কার্যবিবরণী দেওয়ার কথা থাকলেও প্রশাসন তা দিতে প্রায় দেড় মাস সময় নেয়। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত বিকৃত করায় দুজন সিন্ডিকেট সদস্য উপাচার্যকে চিঠিও দিয়েছেন। তারা বলছেন সিন্ডিকেটে নেওয়া হয়নি এমন সিদ্ধান্ত কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছে বাস্তবায়নের জন্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য মোহাম্মদ আলী বলেন, 'আমরা শিক্ষকদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে ৫৪৪ তম সিন্ডিকেটে প্রথম অংশগ্রহণ করেছি। এর আগে সিন্ডিকেটে কোন শিক্ষক প্রতিনিধি ছিল না। সেসময় এক সদস্যের এ কমিটিকে অনুমোদন দেয় সিন্ডিকেট। একজনের এ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে নীতিমালা প্রণয়ন গ্রহণযোগ্য নয়। বর্তমানে একাডেমিক ফলাফলকে সিজিপিএ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও দ্বিতীয় শ্রেণি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালা ভিন্ন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের কৌশল। প্রশাসন এক সদস্যের কমিটি করে বিভাগটিতে আত্মীকরণের নামে আত্মীয়করন করার চেষ্টা করছে। আমরা চিঠি দিয়েছি এবং আমি এর বিরোধিতা করছি'।
আরেক সিন্ডিকেট সদস্য ড. নঈম হাছান আওরঙ্গজেব চৌধুরী বলেন, 'একাধিক শিক্ষকের সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধিত্বশীল কমিটি গঠন করে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে যোগ্যতা শিথিল করা ভিন্ন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের কৌশল হতে পারে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতোমধ্যে অনেকেই স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। এখন পুনরায় বিজ্ঞাপন দিলে যোগ্য শিক্ষক পাওয়া যেতে পারে। এটি নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে বিধায় আগামী সিন্ডিকেটের প্রথম আলোচ্যসূচী হবে এ ইস্যুটি।
সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. শামীম উদ্দিন খান বলেন, আমরা ৫৪৪ তম সিন্ডিকেটে শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে বারবারই বলেছি পুনরায় বিজ্ঞাপনের বিষয়ে। আমরা চাই যোগ্য এবং মেধাবীরা শিক্ষক হোক।
ফিজিক্যাল এডুকেশন এন্ড স্পোর্টস সায়েন্স বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবুল মনছুর বলেন, 'ফিজিক্যাল এডুকেশন ডিপার্টমেন্টে কর্মরত ডেপুটি ডিরেক্টররা শুরু থেকেই এই বিভাগের ব্যবহারিক ক্লাস নিচ্ছেন এবং বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছেন। তাই খণ্ডকালীন দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে তারা অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। তাদের থেকে আত্মীকরণ করার বিষয়ে সুপারিশ এসেছে। যাকে ভালো মনে করেন উপাচার্য তাকে শিক্ষক হিসেবে আত্মীকরণ করে নিবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কে এম নূর আহমেদ বলেন, পুরাতন বিজ্ঞপ্তির যোগ্যতা অনুযায়ী শিক্ষক না পাওয়ায় নতুন করে যোগ্যতা শিথিল করা হয়েছে। তাছাড়া, শারিরীক শিক্ষা বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা স্পোর্টস সায়েন্সে পার্টটাইম ক্লাস নেয়। তাদের মধ্যে একজনকে শিক্ষক হিসেবে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় আত্মীকরণের মাধ্যমে।
যোগ্য শিক্ষকের খোঁজে নতুন করে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হচ্ছে না কেন? এ প্রশ্নের জবাব তিনি দেননি।
প্রসঙ্গত, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) অনুমোদনে ২০১৫ সালে চবি শিক্ষা অনুষদে প্রতিষ্ঠা করা হয় ফিজিক্যাল এডুকেশন এন্ড স্পোর্টস সাইন্স বিভাগ। প্রতিবছর এ বিভাগে মেধাক্রম ও কোটায় ৪০টি আসনে শিক্ষার্থী ভর্তি নেওয়া হয়। তবে, বিভাগ চালুর ৮ বছর শেষ হলেও এখনো পর্যন্ত মাস্টার্স শেষ করে বের হতে পারে নি একটি ব্যাচও। বিভাগটিতে ৮টি সেমিস্টারে ১৭০ জন শিক্ষার্থী থাকলেও এখন পর্যন্ত নিয়োগ দেওয়া হয়নি একজন স্থায়ী শিক্ষকও।