মেডিকেল ফাইল নিয়ে ঘুরতে হবে না আর, হাসপাতালের কাছেই থাকবে আপনার ডিজিটাল রেকর্ড
দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে হেল্থ শেয়ার্ড রেকর্ড (এসএইচআর)—রোগীর স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত তথ্যের ডিজিটাল তথ্যভান্ডার, যা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের মধ্যে আদানপ্রদান হবে—চালু করার পরিকল্পনা করেছে সরকার। এই আধুনিক ব্যবস্থা রোগী ও চিকিৎসকদের ঝামেলা কমানোর পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবায় স্বচ্ছতা ও গুণগত মান আনবে।
প্রস্তাবিত কর্মসূচির আওতায় রোগীদের স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণের জন্য একটি কেন্দ্রীয় ডেটাবেজ তৈরি করা হবে। প্রত্যেক রোগী একটি আইডেন্টিটিফিকেশন নম্বর পাবে। ওই আইডি নম্বরের আওতায় রোগীর মেডিকেল রেকর্ড—রোগ, ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ও চিকিৎসার ইতিহাস—ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হবে। আর এই ইলেকট্রনিক ডেটা যেকোনো সময় সমস্ত হাসপাতাল থেকে দেখা ও সংগ্রহ করা যাবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি হাসপাতালে এ ব্যবস্থাটি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়েছে। এই পাইলট প্রকল্পের ওপর ভিত্তি করে এখন সারা দেশে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের ৬২৩টি হাসপাতালে ডিজিটাল সিস্টেম চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সে উদ্দেশ্যে আনুমানিক ১ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প নেওয়া হবে।
ইতিমধ্যে প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে আগামী দুই বছরের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ডিজিটাল সিস্টেম চালু করা যাবে বলে সূত্র জানিয়েছে।
এই কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য রেকর্ডের কারণে একজন রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিলে তাকে দ্বিতীয়বার আর পুরোনো রোগের কোনো তথ্য ডাক্তারকে দিতে হবে না। রোগ, চিকিৎসক ও চিকিৎসাব্যবস্থা সবই তার আইডিতে সংরক্ষিত থাকবে। ওই রোগী যদি পরবর্তীতে হাসপাতালে আসে, তবে ডেটাবেজ থেকে তার আগের রোগের সমস্ত তথ্য সহজেই পাওয়া যাবে। এতে রোগী ও চিকিৎসক উভয়ের ঝামেলাই কমবে।
এতে চিকিৎসাসেবা দ্রুত ও সহজলভ্য হওয়ার পাশাপাশি সেবার মানও উন্নত হবে বলে মনে করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
প্রকল্প প্রস্তাবের অনুসারে, ইতিমধ্যে ৫৩টি হাসপাতালে ওপেনএমআরএসপ্লাস (ওপেন মেডিকেল রেকর্ড সিস্টেম) নামে একটি ওপেনসোর্স সফটওয়্যার ব্যবহার করে এ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।
এই প্রযুক্তিনির্ভর হেলথ সিস্টেম চালু করা হলে স্বাস্থ্যসেবা খাত দুর্নীতিমুক্ত ও অর্থসাশ্রয়ী হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রকল্প প্রস্তাবে।
প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী, হাসপাতালে ডিজিটাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা চালু করার লক্ষ্যে রোগীদের আইডির ভিত্তিতে তাদের জন্য অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট ব্যবস্থা চালু করা হবে। এছাড়া টেলিমেডিসিন কার্যক্রমও শক্তিশালী করা হবে।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এ প্রকল্পের আওতায় সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয় করে স্থাপন করা হবে। এছাড়া ১ লাখ ৩ হাজার ৮৯০ জন সেবাদানকারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। পাশাপাশি ৪ হাজার ৪৫৮ জন আইটি জনবলও নিয়োগ দেওয়া হবে।
বেসরকারি হাসপাতালগুলোকেও এসএইচআর চালুর পক্ষে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং জাতীয় ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা স্বাস্থ্য বাতায়নের সিইও ডা. নিজাম উদ্দিন আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে যদি ডিজিটালাইজড করা গেলে একটি হেলথ ডেটাবেজ তৈরি হবে, যেখান থেকে মানুষ তাদের আইডি ব্যবহার করে সহজে স্বাস্থ্যসেবা পাবে। আমাদের যেহেতু এনআইডি আছে, সেটি ব্যবহার করে সহজেই এটি করা যাবে। এতে করে দ্বিতীয়, তৃতীয় ভিজিটে যখন রোগী সেবা নিতে আসবে, তখন আর প্রেসক্রিপশন আনতে হবে না, স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডিজিটাল সিস্টেমে তার অতীত রেকর্ড চলে আসবে।'
তিনি বলেন, 'এটি বাস্তবায়ন করা গেলে মানুষের অনেক উপকারে আসবে, ভোগান্তি কমবে।'
তবে এ ব্যবস্থার সঙ্গে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকেও যুক্ত করা উচিত বলে মন্তব্য করেন নিজাম উদ্দিন। কারণ ৭০ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবাই দেয় বেসরকারি খাত। সর্বোচ্চসংখ্যক রোগীর সেবা নিশ্চিতের জন্য সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বয় জরুরি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বেসরকারি উদ্যোগ
বেসরকারি হাসপাতালগুলোর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে নিজস্ব অর্থায়নে ডিজিটালাইজড করার পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
ইতিমধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কোনো বেসরকারি হাসপাতালেও ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এমনই একটি উদ্যোগ হলো 'আলো ক্লিনিক'। আলো ক্লিনিকে রোগীর রেজিস্ট্রেশন থেকে শুরু করে প্রেসক্রিপশন, পরীক্ষার রিপোর্টসহ প্রতিটি ধাপই কম্পিউটারাইজড।
একবার একজন রোগী রেজিস্টার্ড হয়ে গেলে ডাক্তাররা ফলো-আপ বা ভবিষ্যতের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করার জন্য তাদের পূর্ববর্তী চিকিৎসার তথ্য দেখতে পারেন অনায়াসে। আলো ক্লিনিকের ডাক্তারদের তৈরি সমস্ত প্রেসক্রিপশন একটি ক্লাউড সার্ভারে সংরক্ষণ করা হয়।
কড়াইল বস্তি ছাড়াও মিরপুরের দুয়ারীপাড়া, শ্যামপুর শিল্পাঞ্চল, যাত্রাবাড়ীর ধলপুর, টঙ্গীর এরশাদ নগর ও নারায়ণগঞ্জের টানবাজারে আলো ক্লিনিকের শাখা রয়েছে।
ঢাকার বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশন এজেন্সি (সিডা) ও ইউনিসেফের তত্ত্বাবধানে আরেকটি পাইলট প্রকল্প চলছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও এতে সহায়তা করছে।
এছাড়া দেশের বড় বড় বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে পেশেন্ট কার্ড আছে। এ কার্ডে রোগী কবে কোন ডাক্তার দেখিয়েছে, সে সম্পর্কে তথ্য থাকে।
বর্তমানে দেশের প্রায় ৬৫-৬৭ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা দেয় বেসরকারি খাত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন সরকারি হাসপাতালগুলোতে শয্যার সংখ্যা ৫২ হাজার ৮০৭টি, আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে শয্যার সংখ্যা ৯০ হাজার ৫৮৭টি।