গ্লোবাল ফাইন্যান্স রিপোর্ট কার্ড: বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কেন ‘ডি’ গ্রেড, এ প্লাস পেলেন কারা?
বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের র্যাংকিং করেছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিন। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও টাকার অবমূল্যায়নের কারণে এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার 'ডি' গ্রেড পেয়েছেন। অন্যদিকে ভারত, ভিয়েতনাম এবং সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নররা পেয়েছেন 'এ প্লাস' গ্রেড।
রোববার (২৪ সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত গ্লোবাল ফাইন্যান্সের "সেন্ট্রাল ব্যাংকার রিপোর্ট কার্ড ২০২৩" এ বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলা হয়, "এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষেত্রেও পর্যালোচনা মেয়াদের প্রথমার্ধে ম্যান্ডেট পূরণ হয়েছিল: কোভিড-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫.৬%। আবার মূল্যস্ফীতির হার বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫%-এর লক্ষ্যমাত্রাকে কিছুমাত্রায় ছাড়ালেও এ অতিরিক্ত হার সীমিত ছিল ০.৬ শতাংশীয় পয়েন্টে। স্থিতিশীল ছিল টাকার বিনিময় হারও।"
"কিন্তু ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে টাকার ৯.৫% অবমূল্যায়ন হয়। ডলার-সংকটে তখন হাসফাঁস দশা হয় আমদানিকারকদের। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি ও খাদ্যমূল্যও বেড়ে যায়, মূল্যস্ফীতি হয়ে পড়ে লাগামহীন। এ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সহায়তা চায় বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতির কাঠামোগত দুর্বলতা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সরকারের ৬০% নিয়ন্ত্রণের কারণে ২০২২ সালের উচ্চ বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির মতোন বাহ্যিক ঝুঁকিগুলোর শিকার হয় বাংলাদেশ।"
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পাশাপাশি জিম্বাবুয়ের জন মাঙ্গুদিয়া ও সুরিনামের মরিস রোমারও ডি গ্রেড পেয়েছেন।
অন্যদিকে শ্রীলংকাকে দেউলিয়াত্ব ও ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি থেকে বের করে আনা গভর্নর নন্দলাল বীরাসিংহে পেয়েছেন 'এ মাইনাস' গ্রেড।
ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর শক্তিকান্ত দাসকে 'এ প্লাস' গ্রেড দেওয়ার বিষয়ে বলা হয়, 'রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার গভর্নর, শক্তিকান্ত দাস সবল জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে ভূমিকা রেখেছেন। ২০২১ সালে ভারতের অর্থনীতি ৯.১ শতাংশ হারে বিকশিত হয়, যা ছিল সর্বকালের সর্বোচ্চ, আগের বছরে যা ছিল ৮.৭ শতাংশ। সম্ভাবনাময় এই গতির সাথে অন্যান্য প্রধান প্রধান খাতেও তার পারদর্শীতা ছিল উল্লেখ করার মতোন। যেমন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, যেমন জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে ভোক্তা মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশ থেকে কমে ৪.২৫ শতাংশ এসেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গভর্নর বাজারে অর্থপ্রবাহ সংকোচনের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এই ফলাফল তার যৌক্তিকতা তুলে ধরেছে। এজন্য এপ্রিল পর্যন্ত ছয় বার রেপো সুদহার বাড়ানো হয়, এবং তা ৬.৫ শতাংশ পর্যন্ত করা হয়েছে। অভূতপূর্ব এই পারদর্শীতার জন্য (শক্তিকান্ত) দাসকে যথাযথ মূল্যায়ন দিতেই হবে।'
শক্তিকান্ত দাস সম্পর্কে আরও বলা হয়, 'অনিয়মিত ভারি বৃষ্টিপাতে ফসলহানির ফলে জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হার ৭.৪% হয়েছে, অনাকাঙ্ক্ষিত এই পরিস্থিতি তার সার্বিক পারদর্শীতার নির্দেশক নয়, এজন্য সেক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়েছে। তার অন্যান্য বড় অর্জন– ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য তারল্য নীতি চালু এবং এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি নিয়ন্ত্রক কাঠামো প্রতিষ্ঠা– যা গত বছরের অক্টোবর থেকে কার্যকর হয়েছে।'
ভিয়েতনামের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নগুয়েন থি হং-ও র্যাংকিংয়ে 'এ প্লাস' গ্রেড পেয়েছেন। গ্লোবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিন বলেছে, "চলতি বছর সুদহার কর্তন করেছে হাতেগোণা কয়েকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যারমধ্যে স্টেট ব্যাংক অব ভিয়েতনাম অন্যতম। তারা পুনঃঅর্থায়নের নীতি সুদহার চারবার হ্রাস করে, জুন নাগাদ ৪.৫ শতাংশে নামিয়ে আনে। ভিয়েতনামের বাণিজ্যিক ঋণদাতারা এসব কর্তনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ দিতে পেরেছেন। এভাবে দেশটির ঋণ কাঠামোর যৌক্তিকীকরণকে দৃঢ় করেছেন গভর্নর নগুয়েন থি হং। বিশেষত, নগদ অর্থ কম থাকা ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের উদ্যোগগুলো যে কম সুদে ঋণ নিতে পারে তা নিশ্চিত করেছেন।"
১৯৯৪ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গভর্নরদের গ্রেডিং করে আসছে গ্লোবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিন; সাময়িকীটির বার্ষিক প্রকাশনা হিসাবে নিয়মিত 'সেন্ট্রাল ব্যাংকার রিপোর্ট কার্ড' প্রকাশিত হয়ে থাকে।
১০১টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে ২০২৩ সালের সর্বশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের পাঁচটি ক্যাটাগরিতে গ্রেড দেওয়া হয়েছে- এ, বি, সি, ডি এবং এফ। এর মধ্যে এ, বি, সি, এবং ডি ক্যাটাগরিগুলোকে পারফরম্যান্স মূল্যায়নের ভিত্তিতে আরও তিনটি সাব-ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। যেমন, 'এ' ক্যাটাগরির গভর্নরদের 'এ প্লাস', 'এ' এবং 'এ মাইনাস' সাব-ক্যাটাগরিতে মূল্যায়ন করা হয়েছে।
যদি একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অকার্যকর এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ব্যর্থ বলে বিবেচিত হয়, তবে সে দেশের গভর্নরকে 'এফ' ক্যাটাগরিতে ফেলা হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, স্থানীয় মুদ্রা বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা, এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সুসংহত করার মতো বিষয়গুলো গভর্নরদের মূল্যায়নের মানদণ্ড হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে; গত বছর যেসব সূচকে অবনতি হয়েছে বাংলাদেশের।
গ্লোবাল ফাইন্যান্সের মতে, অর্থনৈতিক কাঠামোর দুর্বলতা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণকে বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় দুর্বলতা হিসেবে দেখছে তারা।