জাতীয় নির্বাচনের পর প্রতিমাসে সমন্বয় করা হবে জ্বালানি তেলের দাম
২০২৪ সালের জানুয়ারীতে জাতীয় নির্বাচনের পর পরিশোধিত জ্বালানি তেলের আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে স্থানীয়ভাবে শুল্ক-কর, পরিবহনসহ অন্যান্য চার্জ ও ফি যুক্ত করে প্রতিমাসে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হবে বলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগ।
সম্প্রতি আইএমএফ এর সঙ্গে এক বৈঠকে এ তথ্য জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগ।
ঋণদাতা সংস্থাটির পক্ষ থেকে দৈনিক ভিত্তিতে দাম সমন্বয় করা সম্ভব কি-না, তা জানতে চাওয়া হয়। এতে সম্মতি দেয়নি জ্বালানি বিভাগ।
আজ বুধবার (১১ অক্টোবর) জ্বালানি খাতের পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে আইএমএফ মিশন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন(বিপিসি) ও পেট্রোবাংলার সঙ্গে বৈঠক করবে।
জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জ্বালানি তেলের আমদানি ব্যয় ডলারে হিসাব করে তা তখনকার এক্সচেঞ্জ রেট অনুযায়ী টাকায় কনভার্ট করে আমদানি ব্যয় নির্ধারণ করা হবে। এর সঙ্গে শুল্ক-কর, ডিলার কমিশন ও চার্জ, পরিবহন ফি এবং কিছু মুনাফা যুক্ত করে দাম নির্ধারণ করা হবে।
জ্বালানি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ইমপোর্ট প্যারিটি প্রাইসের ভিত্তিতে ফর্মুলা প্রণয়ন করা হচ্ছে। অর্থাৎ, আমদানি ব্যয় অনুযায়ী দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ওঠানামা করবে। তবে এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে পরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বিবেচনায় নেওয়া হবে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বাংলাদেশ যত জ্বালানি তেল আমদানি করে তার ৭০% পরিশোধিত তেল।
এই ফর্মুলা প্রণয়নে ভারতের জ্বালানি তেলের দরও বিবেচনায় রাখা হয়েছে। প্রতিবেশি দেশটির সঙ্গে জ্বালানি তেলের চোরাচালান বন্ধে বাংলাদেশে তেলের দাম ভারতের বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্ধারণ করা হবে।
জ্বালানি তেলের ভোক্তা পর্যায়ে দাম নির্ধারণে কিছুটা মুনাফা যুক্ত করার কারণ সম্পর্কে জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, সরকার বেসরকারি খাতে রিফাইনারি স্থাপন ও জ্বালানি তেল বিপণন নীতিমালা করছে। এটি হলে সারাদেশে সরকারি ও বেসরকারিখাতের জ্বালানি তেল একই মূল্যে বিক্রি হবে। তাই মূল্য নির্ধারণের সময় বেসরকারি কোম্পানিগুলোর জন্য মুনাফা নির্ধারণ করে মূল্য নির্ধারণ করা হবে। ফলে সরকারও তার সুফল পাবে।
আইএমএফ এর ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্ত হিসেবে আগামী বছরের মার্চ থেকে নতুন ফর্মুলায় দাম নির্ধারণ করার কথা রয়েছে। আর গত সেপ্টেম্বরের মধ্যে পেট্রোলিয়াম পণ্যের ক্ষেত্রে একটি 'পর্যায়ক্রমিক ফর্মুলা-ভিত্তিক মূল্য সমন্বয় প্রক্রিয়া' চালু করার শর্ত ছিল আইএমএফ'র। সরকার সেপ্টেম্বর থেকে দাম সমন্বয়ের ঘোষণা দিলেও বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে নির্বাচনের আগে সমন্বয় করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে জ্বালানি বিভাগ।
জ্বালানি বিভাগ ডিজেলের বিক্রয় মূল্যের ২.৮৫%, কেরোসিনে ২%, পেট্রোলে ৪.৩৪% এবং অকটেনে ৪.২৮% কমিশন নির্ধারণ করেছে। পরিবহন ভাড়াও শতকরা হারে নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে জ্বালানি তেল আমদানিতে ৩৫% কর ও ভ্যাট রয়েছে।
সর্বশেষ গত বছরের ৩০ আগস্ট সরকার নির্বাহী আদেশে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিন ১০৯ টাকা, প্রতি লিটার পেট্রোল ১২৫ টাকা ও প্রতি লিটার অকটেন ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। এরপরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দামে ওঠানামা হলেও সরকার দাম পরিবর্তন করেনি।
সৌদি আরামকোর ঘোষিত ভোক্তামূল্য অনুযায়ী বর্তমানে বিইআরসি ভোক্তা পর্যায়ে এলপিজির দাম নির্ধারণ করছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাজারের সাথে সমন্বয় করে নির্ধারণ করা যৌক্তিক।
"কারণ বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও সরকার দেশে কমায় না। আবার দাম বেড়ে গেলে দেশে সমন্বয় করতে দেখা যায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করে দাম নির্ধারণের ফর্মুলা চালু হলে বাজারের অন্যান্য পণ্যের মত জ্বালানি তেলের দামেও একটা ওঠানামা থাকবে," বলেন তিনি।
তবে বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের ওপর শুল্ক কর অনেক বেশি উল্লেখ করে তিনি বলেন, "উচ্চ শুল্ক থাকলে সাধারণ ভোক্তা, উৎপাদন, রপ্তানিকারক, আমদানি শিল্পের খরচ বেড়ে যাবে। যা মানুষের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। এজন্য দাম নির্ধারণের এই ফর্মুলাতে শুল্ক পুননির্ধারণের সুযোগ থাকতে হবে। যাতে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে গেলেও দেশের মানুষকে স্বস্তি দিতে শুল্ক কমানো যায়।"
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন টিবিএসকে বলেন, "ফর্মুলা ভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি ইতোমধ্যে এলপিজিতে অনুসরণ করা হচ্ছে। এতে কোন মাসে দাম বাড়ছে, আবার কোনো মাসে কমছে। অস্বাভাবিক কিছু না ঘটলে মোটামুটি একটা রেঞ্জের মধ্যে থাকছে। জ্বালানি তেলের বেলায়ও সেরকমই হবে।"
তিনি বলেন, "ফর্মুলা ভিত্তিক প্রাইস অ্যাডজাষ্টমেন্টের সুবিধা হচ্ছে দাম কমলে গ্রাহকরা কম দামে পণ্য পান। আবার বাড়লে সরকারকে লোকসান করতে হয় না। অনেক দেশ এভাবে মূল্য নির্ধারণ করছে।"
"বাংলাদেশে এ ধরনের পদ্ধতি চালুর বিষয়ে অনেক আগে থেকেই বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন। কিন্তু এতদিন সরকার সেটা বিবেচনা করেনি। এখন আইএমএফের শর্ত বা সামগ্রিক বিবেচনায় সরকার সেটা করছে। এটা ইতিবাচক। কারণ এ ধরনের ফর্মুলা হলে একটা স্বচ্ছতা থাকে, কারো কিছু বলার থাকে না," বলেন তিনি।
তবে এক্ষেত্রে কর নির্ধারণ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করেন ড. ইজাজ। তিনি বলেন, "জ্বালানি তেলের মূল্যের শতকরা হারে কর নির্ধারণ করা ঠিক হবে না। একটি নির্দিষ্ট কর থাকতে হবে। শতকরা হারে কর নির্ধারণ হলে জ্বালানি তেলে দামে সেটি ঊর্ধ্বমূখী প্রভাব ফেলবে।"