ইলিশের ষষ্ঠ অভয়াশ্রমে মা ইলিশ শিকারের উৎসব
মৎস সম্পদ বাড়াতে সরকার নির্ধারিত ২২ দিনে ইলিশ শিকার, ক্রয়-বিক্রয়, পরিবহন, মজুদের ওপর চলছে নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু এসবের কোন তোয়াক্কাই নেই মেঘনা নদীতে। মূলত শরীয়তপুর জেলার গোসাইরহাট উপজেলা, বরিশাল জেলার হিজলা ও মুলাদী উপজেলার সীমান্তবর্তী মেঘনা ও তার শাখানদী এবং কীর্তনখোলা নদী মিলিয়ে ৩১৮ বর্গকিলোমিটার জুড়ে ২০১৯ সালে দেশের ষষ্ঠ অভয়াশ্রম হিসেবে গেজেটভুক্ত করে। অভয়াশ্রমে প্রজননের জন্য মা ইলিশ উঠে আসে।
নিষেধাজ্ঞা চলমান এই সময়েও অভয়াশ্রমে মাছ শিকার বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। প্রতিদিন ভোর থেকে শুরু করে রাতভর ইঞ্জিন চালিত ছোট ছোট ট্রলারে মাছ শিকারে নামে জেলেরা। জেলেদের অধিকাংশ পেশাদার হলেও অনেকে মৌসুমী জেলে। শুধু শিকার করেই থামছেন না, আশপাশের বাজারে জটলা করে বিক্রি করছেন তা।
সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো এসবই ওয়াকিবহাল। তবে জেলেদের মরিয়া অবস্থানে নিশ্চুপ প্রশাসন।
রোববার (১৫ অক্টোবর) দুপুর থেকে সরেজমিনে হিজলা উপজেলার হরিনাথপুর ইউনিয়নের আবুপুর লঞ্চঘাট সংলগ্ন নদীতে বেশ কয়েকটি ইঞ্জিনচালিত ছোট ট্রলারকে ইলিশ শিকার করতে দেখা গেছে। ওই এলাকার জেলেরা জানিয়েছেন, শুধু আবুপুর নয় হিজলা, মুলাদি, মেহেন্দীগঞ্জ, চাঁদপুরের হাইমচর থেকে শুরু করে ভোলার তেঁতুলিয়া নদী পর্যন্ত শাখানদীগুলোতে সংঘবদ্ধভাবে মাছ শিকা্র করে থাকে জেলেরা। এসব মাছ নিকটস্থ চাঁদপুর, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলার বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হয়। এমনকি মেঘনার তীরের আবুপুর, হিজলা-গৌরবদি ইউনিয়নের খালিসপুর, জানপুর এলাকায় রাখঢাক ছাড়াই মা ইলিশ বিক্রি করতে দেখা গেছে।
আবুপুর এলাকার জেলে হোসেন বলেন, সরকার থেকে যে প্রণোদনা দেয়, তা আমরা পাই না। সংসার তো চালাতে হবে। এজন্য বাধ্য হয়ে নদীতে মাছ শিকারে নামতে হচ্ছে।
হাশেম মিয়া নামের আরেক জেলে বলেন, সরকারের সহযোগিতা আমাদের হাত পর্যন্ত এসে পৌঁছায় না। তারা জেলেদের যা সহায়তা দেয় তাতে পরিবার নিয়ে চলতে কষ্ট হয়। তাই বাধ্য হয়ে মাছ ধরতে নেমেছি। এই এলাকায় প্রশাসন কম আসে বলে এখানে এসেছি।
রুবেল মৃধা নামে আরেক মাঝি বলেন, প্রশাসন শুধু আমাদের সাথেই পারে। আমাদের এখানে নিষেধাজ্ঞার সময়ে ভারতের জেলেরা ঠিকই মাছ ধরে নিয়ে যায়। তাছাড়া আমরা মাছ শিকারে না নামলে, এলাকার নেতারা লোক দিয়ে জাল ফেলে। মাছ শিকার তো বন্ধ হচ্ছে না। অন্যরা মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে, আমি ধরলে দোষের কি!
হরিনাথপুরে ইউনিয়নের এক জনপ্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এই অঞ্চলটির জেলেরা অনেক মারমুখী। বিগত দুই-তিন বছরে ৪/৫টি হামলা করেছে প্রশাসনের ওপর। তাদের হামলার শিকার হয়েছে কোস্ট গার্ড, পুলিশ, মৎস কর্মকর্তা এমনকি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও। এই অঞ্চলে ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন আছেন, যারা জেলেদের দিয়ে ইলিশ শিকার করান। কোন ঝামেলা হলে তারা তা ম্যানেজ করেন। ফলে স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি এড়িয়ে যান।
ওই জনপ্রতিনিধি স্বীকার করেন, অভয়াশ্রমে তারও দুটি ট্রলার মাছ শিকারে যায়। অভয়াশ্রমে মাছ শিকার ক্ষতি বুঝলেও তার দাবি, আমি না ধরলেও অন্যরা ধরে নিয়ে যাবে। প্রশাসন ভয়ে এদিকে আসে না। এলাকাটি বরিশাল ও শরীয়তপুর জেলার সীমানা হওয়ায় এখানে প্রশাসনের নজরদারি তেমন থাকে না। মাঝেমধ্যে প্রশাসন কাউকে আটক করলেও সীমানা জটিলতায় ছেড়ে দেয়।
মেঘনায় ইলিশ শিকারের সত্যতা স্বীকার করেছেন বরিশাল জেলা মৎস কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, আবুপুর ওই এলাকাটিতে একটু ঝামেলা রয়েছে। এর আগে কয়েকবার অভিযান বাধার মুখে পড়েছে। ফলে সেখানে একটি নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়েছে। তারপর এমন চিত্র (ইলিশ শিকারের) থাকার কথা না। এই কর্মকর্তা আবুপুর পুলিশ ফাঁড়ির সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন।
শরীয়তপুর জেলা মৎস কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, দুটি জেলার বা তিনটি উপজেলার সংযোগস্থল মেঘনা নদীর ওই এলাকায় জেলেদের মাছ শিকারের অভিযোগ আমরা জেনেছি। সমস্যা হচ্ছে জেলেরা অত্যন্ত চতুর। যখন শরীয়তপুর জেলার কোন টিম ওই এলাকায় আভিযানে যায়, তখন তারা বরিশালের সীমানায় ঢুকে অবস্থান নেন। আবার যখন বরিশালের আভিযানিক দল আসে, তখন তারা শরীয়তপুরের সীমানায় ঢুকে অবস্থান নেন। ফলে জেলেদের সাথে পেরে ওঠা কষ্টসাধ্য হয়ে পরে।
মৎস অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক নৃপেন্দ্র নাথ বিশ্বাস বলেন, মেঘনার ওই অঞ্চলে জেলেরা নির্দেশনা উপেক্ষা করেই মা ইলিশ নিধন করছেন এমন সংবাদ আমি জানতে পেরেছি। তবে আমরা চেষ্টা করছি কোস্ট গার্ড, মৎস অধিদপ্তর, নৌ-পুলিশ সমন্বিতভাবে অভিযান পরিচালনার। শিগগিরই এই অভিযান পরিচালনা করে ইলিশ নিধনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
নৌ-পুলিশ বরিশাল জোনের পুলিশ সুপার কফিল উদ্দিনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
প্রসঙ্গত, বিগত ২৪ ঘন্টায় বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় অভিযান শুরুর পর থেকে মোট ৭৭জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বরিশাল জেলায় ৬৩ জন, ভোলায় ৫ জন, বরগুনায় ১ জন, পটুয়াখালীতে ৮জন। ৪৩৭টি অভিযানে ৮৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ষষ্ঠ অভয়াশ্রমের আওতায় রয়েছে মেঘনা নদীর দক্ষিণ-পশ্চিমে বরিশাল সদর উপজেলার জুনাহারের মোড় আড়িয়াল খাঁ, কীর্তনখোলা, কালাবদর নদীর মিলনস্থল। এর দক্ষিণ-পূর্বে মেহেন্দিগঞ্জের জাঙ্গালিয়ার কালাবদর ও তেঁতুলিয়া নদীর মিলনস্থল। উত্তর-পশ্চিমে হিজলার হরিণাথপুর সংলগ্ন আড়িয়াল খাঁ ও মেঘনা নদীর মিলনস্থল। উত্তর-পূর্বে হিজলা গৌরবদীর মেঘনা নদী।