বেড়েছে হ্যান্ড-ফুট-মাউথ রোগ, অ্যান্টিবায়োটিক না খাওয়ানোর পরামর্শ চিকিৎসকদের
গত ৪ অক্টোবর গায়ে হালকা জ্বর আসে রাজধানীর লালবাগের বাসিন্দা ৬ বছর বয়সী তাসফিক হাসানের। একই রাতে তার ছোট ভাই নাইফ মোহাম্মদেরও (২) জ্বর আসে। এর দুই দিন পর দু'জনের মুখে র্যাশ উঠে, মুখের ভিতরে ঘা হয়। আজিমপুর প্রসূতি হাসপাতালে নেয়ার পর জানা যায়, হ্যান্ড–ফুট অ্যান্ড মাউথ রোগে আক্রান্ত দুই ভাই। চিকিৎসকের পরামর্শে নাপা সিরাপ ও অ্যান্টি হিস্টামিন ওষুধ খাওয়ানোর এক সপ্তাহ পর সুস্থ হয়েছে দুই ভাই।
তাসফিক ও নাইফের মতো গত কিছুদিন ধরে শিশুদের মধ্যে হ্যান্ড–ফুট–মাউথ রোগে আক্রান্তের হার বাড়ছে। শিশুর হঠাৎ অসুস্থতায় উদ্বিগ্ন অভিভাবকেরা, তবে ভাইরাসজনিত এ রোগে অ্যান্টিবায়োটিক না খাওয়ানোর পরামর্শ চিকিৎসকদের।
শিশুদের আকস্মিক অসুস্থতায় তাদের অভিভাবকেরা শঙ্কিত বোধ করলেও চিকিৎসকেরা তাদের আতঙ্কিত না হওয়ার এবং এই ভাইরাল রোগের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করার পরামর্শ দেন।
ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত রোগটি শিশুদেরই বেশি প্রভাবিত করে। এই রোগের উপসর্গের মধ্যে রয়েছে মুখে ঘা এবং হাত ও পায়ে ফুসকুঁড়ি।
তাসফিক হাসানের মা তৃপ্তি হাসান টিবিএসকে বলেন, "প্রথম দিন আমার ছেলেদের গায়ে হালকা জ্বর ছিলো, তারপর মুখে পক্সের মত একটি গোটা ওঠে। কিন্তু তারপরই মুখের ভিতরে ঘা হয়। বড় ছেলেকে জোর করে কিছু খাওয়ানো গেলেও ছোট ছেলে পানি ছাড়া কিছু খায় নি। আমার ছোট ছেলেটা খুব কষ্ট পেয়েছে।"
''আমার ননদের ৮ মাস বয়সী বাচ্চারও এই রোগ হয়। তার মুখে এতো ঘা হয়েছিলো যে ৬ দিন কিছুই খেতে পারেনি, বাচ্চা এতো দুর্বল হয়ে গিয়েছিলো যে তাকে স্যালাইন দিতে হয়েছিলো। রোগটি যেহেতু অনেক ছোঁয়াচে তাই স্কুল বা মাদ্রাসা থেকে আমার বড় ছেলে এটিতে আক্রান্ত হয়েছে বলে আমার ধারণা। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের দুই বাচ্চারও এ রোগ হয়েছে", যোগ করেন তৃপ্তি হাসান।
'শিশুদের দিনলিপি' নামের একটি ফেসবুক পেজে রোববার (১৫ অক্টোবর) রেবেকা মনসুর নামে একজন অভিভাবক লিখেছেন, "হ্যান্ড–ফুট–মাউথ রোগে আক্রান্ত হয়ে আমার মেয়ে এতো অসুস্থ ছিলো যে ঔষধ খাওয়ার মতো অবস্থায়ও ছিল না, ১০৪ ডিগ্রি জ্বর ছিল, পরে হসপিটালাইজড করতে হয়েছে। এখন সুস্থ হয়েছে।"
পোস্টটিতে অনেক অভিভাবক উল্লেখ করেন যে, তাদের সন্তানেরাও এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেডিয়াট্রিকস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মানিক কুমার তালুকদার বলেন, "হ্যান্ড–ফুট–মাউথ রোগ অনেক বেড়ে গেছে। প্রতিদিন চেম্বারে এ রোগে আক্রান্ত ৫-৬টি রোগী পাচ্ছি। এ রোগে আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় না, তাই আউটডোরে ও চেম্বারে এসব রোগী বেশি পাওয়া যায়।"
তিনি জানান, এই রোগের কোনও নির্দিষ্ট প্রতিকারমূলক চিকিৎসা নেই। লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হবে। কারো জ্বর আসলে নাপা সিরাপ খাওয়াতে হবে, গা চুলকালে অ্যান্টি হিস্টামিন জাতীয় ওষুধ দিতে হবে। এটি যেহেতু ভাইরাসজনিত রোগ, তাই অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার প্রয়োজন নেই। লক্ষণ প্রকাশের ৭-১০ দিনের মধ্যে রোগী সুস্থ হয়ে যাবে।
অভিভাবকদের আতঙ্কিত না হলে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে এ চিকিৎসক ঘন ঘন হাত ধোয়ার অভ্যাস এবং এ রোগে আক্রান্তদের সাথে নিবিড় যোগাযোগ এড়িয়ে চলতে বলেন।
সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন জানিয়েছে, সাধারণত পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা হ্যান্ড–ফুট–মাউথ রোগে আক্রান্ত হয়, তবে যে কেউই সংক্রমিত হতে পারে। অসুস্থতা খুব একটা গুরুতর রূপ নেয় না, তবে রোগটি অত্যন্ত সংক্রামক এবং স্কুল ও ডে-কেয়ার সেন্টারে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
এর উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে জ্বর, গলা ব্যথা এবং জিহবা, মাড়ি, গালের ভিতরে এবং কখনো কখনো তালু বা নিতম্বে বেদনাদায়ক ফোস্কাসদৃশ ক্ষত আর ফুসকুঁড়ি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পেডিয়াট্রিকস বিভাগের প্রধান এবং অধ্যাপক ইফফাত আরা সামাদ বলেন, "গত ৩-৪ বছর ধরে এই রোগটি আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে। এটি অনেক ছোঁয়াচে রোগ। অনেকটা জলবসন্তের মতো কিন্তু এটি জলবসন্ত না। এটি কয়েকদিন পর স্বাভাবিকভাবে ভালো হয়, এ রোগে কোন অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া যাবে না। এ রোগের লক্ষণ দেখা দিলে শুরুতেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, আক্রান্ত শিশুকে স্কুলে পাঠানো যাবে না।"