আশুলিয়ায় অনির্দিষ্টকালের জন্য শতাধিক কারখানা বন্ধ
ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে পোশাক খাতের শ্রমিকদের টানা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকার আশুলিয়ায় শ্রম আইনের ১৩/১ ধারা অনুযায়ী শতাধিক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া গত বৃহস্পতিবার (৯ নভেম্বর) পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ'র এক সমন্বয় সভায় নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতিটি কারখানার সামনে 'নিয়োগ বন্ধ' লেখা ব্যানারও টানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সকালে কারখানাগুলোর সামনে গিয়ে বন্ধের নোটিশ দেখে ফিরে গেছেন অনেক শ্রমিক।
শনিবার (১১ নভেম্বর) আশুলিয়ার জামগড়া, ছয়তলা, নরসিংহপুর, জিরাবো, কাঠগড়াসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এসব এলাকার এনভয়, হা-মীম গ্রুপ, শারমীন গ্রুপ, স্টারলিং গ্রুপসহ অধিকাংশ পোশাক কারখানাই ১৩/১ ধারায় বন্ধ ঘোষণা করে কারখানার গেইটে নোটিশ ঝুলিয়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। যার অধিকাংশ নোটিশই গত বৃহস্পতিবার স্বাক্ষরিত।
শারমীন গ্রুপের শারাফ এমব্রয়ডারি এন্ড প্রিন্টিং লিমিটেডের নোটিশে বলা হয়েছে, গত ৩০ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত এ কারখানার শ্রমিকরা বে-আইনিভাবে কাজ বন্ধ রেখে সকালবেলা হাজিরা দিয়ে বের হয়ে চলে যায়। এ ছাড়াও শ্রমিকরা কারখানার ভেতর ও বাইরে ব্যাপক ভাংচুর, মারামারি, ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ অরাজকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যাতে কারখানার সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি ও আর্থিক ক্ষতিসাধনও হয়।
নোটিশে আরও বলা হয়, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে গত ১ ও ২ নভেম্বর সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এরপরও শ্রমিকরা ফ্যাক্টরিতে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মারামারি ও ভাংচুর অব্যাহত রাখে। এসব ঘটনাকে 'বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬' অনুযায়ী 'অবৈধ ধর্মঘট' হিসেবে উল্লেখ করা হয় এ নোটিশে।
এ কারণে শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারা অনুযায়ী আজ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে তারা।
কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হলেও সকালে বেশ কয়েকজন শ্রমিকের সাথে কথা বললে তারা জানান, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির দাবির পক্ষে তারা এখনও অনড়।
সকালে শারমিন গ্রুপের একটি পোশাক কারখানার একজন অপারেটর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মালিক কারখানা বন্ধ করেছে, আবার যখন ঠিক মনে করবে খুলে দিবে। তবে আমাদের দাবি যেটি ছিল, এখনও সেটি আছে। আমাদের দাবি হেলপারদের অন্তত ১৭ হাজার টাকা ও অপারেটরদের মজুরি যেন অন্তত ২৩ হাজার টাকা করা হয়।"
এসময় নিজের দাবির পক্ষে অনড় থাকার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে এই কর্মী বলেন, "বর্তমান বাজারে সাড়ে ১২ হাজার টাকায় কি চলা যায়? বেতন নিয়ে সমস্যা হলে আমাদের বেতন বাড়াতে হবে না, আপনারা জিনিসপত্রের দাম কমান, বাসাভাড়া কমান, সার্ভিস কোয়ার্টার খুলে দেন আর লাঞ্চের ব্যবস্থা করুন। আমাদের এই কষ্টটাই তো কেউ বুঝলো না। আমার দুটো সন্তান আছে। এই টাকায় কিভাবে সংসার চালাই?"
হামীম গ্রুপের সামনে অপেক্ষারত রিফা নামে একজন শ্রমিক টিবিএসকে বলেন, "৫ বছর আগে জিনিসপত্রের যেই দাম ছিলো, এখন কি তা আছে? আপনারা বেতন বাড়াচ্ছেন কিন্তু কত টাকা বাড়লো? এই বেতনে যদি চলা না যায় তাহলে বাড়তি বেতন দিয়ে কী হবে? বেতন যদি আর বাড়াতে না পারে তাহলে সব জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে দিক, অন্যথায় আমাদের মজুরি আরও বৃদ্ধি করতে হবে এটাই আমাদের দাবি।"
কারখানায় হামলা ও ভাংচুরের ঘটনায় ৭ মামলায় গ্রেপ্তার ৪ জন
মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে এই শিল্পাঞ্চলে পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলনের মধ্যে বিভিন্ন কারখানায় হামলা ও ভাংচুরের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় এখন পর্যন্ত মোট ৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম।
এসব মামলায় মোট ১৬ জনের নাম উল্লেখ করাসহ অজ্ঞাতনামাদের আসামী করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত মোট ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলেও নিশ্চিত করেন পুলিশ সুপার।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "এসব মামলায় ১৬ জনের নাম উল্লেখ করাসহ অজ্ঞাতনামাদের আসামী করা হয়েছে। তার মধ্যে মামলায় যাদের নাম ছিলো এবং এসব ঘটনায় যারা সরাসরি জড়িত ছিলো তাদের মধ্য থেকে ৩ জন ও অজ্ঞাতনামাদের মধ্য থেকে ১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তদন্ত চলমান আছে, কোন নিরীহ শ্রমিক যেন হয়রানির শিকার না হন সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।"
গ্রেপ্তারকৃতদের সকলেই বিভিন্ন কারখানার পোশাক শ্রমিক বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
মোহাম্মদ সারোয়ার আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "যেসকল কারখানায় শ্রমিকরা প্রবেশ করেও কারখানায় কাজ করা থেকে বিরত ছিলেন, সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাইয়ে এমন ১৩০টি কারখানা ১৩/১ ধারায় বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে শুধু আশুলিয়াতেই এমন কারখানার সংখ্যা ১০০-এর অধিক।"
তিনি বলেন, "আমাদের এই জোনে সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাইতে প্রায় ১৭৯২টি পোশাক কারখানা রয়েছে। বাকিগুলোতে স্বাভাবিকভাবে কার্যক্রম চলমান আছে। যেসব কারখানায় কাজ চলছে, শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করছেন, সেসব কারখানায় শ্রমিকরা যেন নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারেন সেটি নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।"
এছাড়াও শিল্পাঞ্চলের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন রয়েছে বলে জানান তিনি। নিয়মিত টহল কার্যক্রমও চলমান আছে।
সকাল থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত সাভার, আশুলিয়ার কোথাও কোন শ্রমিক বিক্ষোভের খবর পাওয়া যায়নি, গোটা শিল্পাঞ্চলের পরিস্থিতি আজ শান্ত রয়েছে।